বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিলম্যাগাজিন ব্লগ

সাম্প্রতিক পোষ্ট

আধিপত্যের স্থাপত্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গ: ছোটকাগজের পাটাতনে চেরাই হতে থাকা ইতিহাসের মানুষজন




  

“আমাদের মানুষগুলো হঠাৎ করে বদলে যাচ্ছে,
        বোধগত কোন কিছুই, সমাজ-সংসার, পরিবার এর উপর
ব্যক্তিগত কোন প্রভাব আদৌও কি ফেলেছে!
শুধু দেখছি বড় বড় শিয়ালের বড় বড় কাটা লেজ।”

১.
সমুদ্রে ঝড় ওঠে সমুদ্রের উপরিভাগে, এ ঝড় সমুদ্রের তলদেশে পৌছায় না। যিনি চিরন্তন সত্য উপলব্ধি করেন তিনি প্রতিটি সময়ের রুপান্তর যাচাই করে দেখেন। অবিচল থাকেন সময়ের সার সত্য অনুসন্ধানের। এই ধ্রুব সত্য অনুসন্ধানের পথে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দি হয়ে ওঠেন। আর যিনি ব্যার্থ হন তিনি গা ভাসিয়ে দেন অন্ত:সারশূন্য বায়বীয়  মরিচীকায়। কারন তিনি নিজেই দ্বীধাগ্রস্থ তাই সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেন না। ইতিহাসের পাতায় হাজার হাজার এই রকমের জড় পদার্থের গুন সম্পন্ন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। আর এরাই খুব সহজে তথাকথিত বুঁর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদীরা, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ফরমায়েশী সাহিত্যেক হয়ে ওঠেন সামান্য  অর্থ, প্রচার,যশ,প্লাষ্টিকের পদক এর বিনিময়ে লেখক নামক এই মেধাহীন জড় পদার্থের গুন সম্পন্ন মানুষগুলোকে ওরা সহজে খুঁজে নেয়। আর সেই সুযোগে ঔ মুনাফা লোভী পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশী সাহিত্যিকগণ নিজের অজান্তে বিক্রি হওয়া ধান্দাবাজরা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ¯ী^কৃতি দিয়ে প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল তকমা দিয়ে পুঁষে রাখে। অথচ তাদের সাহিত্যের প্রতি নিজেদের কোন সুানির্দ্দিষ্ট কমিটমেন্ট নেই, নেই কোন দায়বদ্ধতা না পাঠকের প্রতি,না সমাজের প্রতি , না বাংলা সাহিত্যের প্রতি। তবে এদের আছে লোক দেখানো দেশপ্রেম, টকশোতে, সভা, সেমিনারে মুখস্ত বিদ্যার গরম বক্তৃতা দেবার প্রশিক্ষিত দক্ষতা।

প্রাচীন প্রবাদে আছে, “মরা কুত্তাকে কেউ লাথি মারে না”।

ঠিক এইভাবে  মুনাফা লোভী পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশী  সাহিত্যিকগণ কে ওরাই প্রায় মরা কুকুরের মত লালায়িত করে হাড্ডি ছুড়ে দেয় আর এরা লেজ নাড়িয়ে জিহ্বায় লালা ঝরিয়ে সেই হাড্ডি ফেরত নিয়ে আসে নির্লজ্জের মত। পাশাপাশি বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এই পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশী  সাহিত্যিকগণ কে বনসাঁই করে রাখতে নিয়মিত পরিচর্যা করছে, পণ্য সাহিত্যের উৎপাদন সংখ্যা বৃদ্ধি, লেখকের সৃজনশীল চৈতন্যের বিকাশ সহ ব্যক্তি লেখক সত্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা কে শেকল পরিয়ে দিয়ে বলছে,

“ওটা শেকল নয় নূপুর, তোমরা কুকুর নও ময়ূর”।

প্রতিষ্ঠান বিরোধী  তথা লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট  তথাকথিত বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশী সাহিত্যিকগণদের তৈরি সকল বাজারি প্রডাক্ট বা পণ্য সহ সকল লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশকদের দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করে, অস্বীকার করে। আপনারা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে বমি করছেন আর নিজেদের সেই বমি নিজেরাই চাটছেন। এবার সময় হয়েছে চাটাচাটির দিন শেষ। নব্বই পরবর্তী  প্রজন্ম ঘুমিয়ে নেই। ওরা সদা জাগ্রত, সময়ই সময়ের প্রয়োজনে হুংকার দিয়ে উঠবেই।

“সৎ ও নিষ্ঠাবান শিল্পী তাঁর শিল্পচর্চার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা ও আড়ষ্টতাকে
ঝেড়ে ফেলার সাধনা করে যান । "
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)।(১)

গৃহপালিত আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুরতোলা এই বাজারি লেখকরা বুঝতেই চাননা নাকি বুঝতেই পারে না অনুভবের শক্তিহীন, উপলব্ধিহীন, হাড্ডি প্রাপ্তিতে সন্তুষ্টরা সর্বদা নিজেদের কথাই ভাবেন।তাদের সৃষ্টকাজ এ কোন কমিটমেন্ট নেই আছে পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশীপনা। তাদের কে পাঠককূল গ্রহন করতে কতখানি আগ্রহী সেটা তাদের বোধগম্য নয়। নিজেরাই নিজেদের কল্পনার ফাঁনুসে গাভাসিয়ে রেখেছে। এ সত্ত্বেও এই অনা-সৃষ্টিকারক দল সারা জীবন নিজেদের ফরমায়েশী সৃষ্ট প্রডাক্ট বিক্রির চেষ্টারত। অথচ পাঠকূল কি চায় সেই দৃষ্টিকোণ দিয়ে না দেখে নিজেদের চকচকে মোড়কের আড়ালে রেখে নিজেদের উপস্থাপন করছে। নিজেদের উলঙ্গ করে ঢাক পেটাচ্ছে। বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশী সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক বাজারি দৈনকের সাময়িকী, মিডিম্যাগ ও মুখোশধারী লিটিলম্যাগ সংখ্যার পর সংখ্যা করে তাদের বাহবা নিয়ে প্রতিষ্ঠান নির্ভর দালাল চক্র তাদের সাহিত্যকর্ম প্রচার করে তাদেরকে অমরত্ব নামক গন্ধব ফলের লোভ দেখিয়ে যাচ্ছে। মিডয়িা ওয়াকার বানিয়ে তাদের প্রচার-প্রসার করে বলছে পাঠকগণের নিকট তোমরা প্রশংসিত।

এইসব ধান্দাবাজ সাহিত্যিক নামধারী ব্যক্তিদের দ্বারা বাংলা সাহিত্যের আদৌ কি কোন মৌলিক লাভ হয়েছে?

শিল্প, ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম-মানব সংস্কৃতির অধ্যায়নে গভীরভাবে এবং আবেগপূর্ণভাবে জড়িত হওয়ার জন্য, তাদের প্রতিরোধ এবং গ্রহণের আহ্বান প্রক্রিয়ারত প্রতিষ্ঠানবিরোধী তথা লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট। যদিও কয়েকজনই সর্বজনীনভাবে বলবেন, মানবতার জন্য সমসাময়িক উচ্চতর পাঠক্রমের একটি বৃহত্তর ভূমিকা প্রদানের বিরোধিতা করে বিতর্কের মধ্যে রয়েছে লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট, এমন কয়েকজন ব্যক্তিও রয়েছেন। যখন তারা বিরোধিতা করে, তখন তারা প্রায়ই প্রতিক্রিয়াশীল, অনুভূতিশীল, মানবিক ধারণা হয় যে, মানবিকতাগুলি বিষয়ে সমাজের অনুভূতির একটি গ্রুপ হিসাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী  তথা লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট বিবেচনার চেয়ে, যে মানবিক সহজ, একটি নরম ও চরম বিকল্প; যে মানবিক চিন্তাবীদদের প্রশিক্ষণের জন্য না স্বাধীনতার জন্য। তারা একটা কাজ স্বার্থক ভাবে গুছিয়ে করেছে, সেটা হলো ব্যক্তিগত অর্থযোগ, পুরুস্কার এর জন্য রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলবাজি, দশকবাজির রঙ, ঢং।  এই মেধাবিক্রিত প্রাতিষ্ঠানিক তৃতীয় বিশে^র গণতন্ত্রের মোড়কের দ্বারা বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদের সাহিত্যে সামাজীকরণ প্রক্রিয়ায় দশকীয় সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে মাতামাতি করছে। আর মনেপ্রাণে ভাবছে এসকল প্রতিষ্ঠান এর কারনে তাদের সাহিত্যকর্ম স্বীকৃত হচ্ছে। আদৌ কি তাই ঘটছে? এজন্য তাদের প্রতি বিন¤্র করুণাময় শুভ কামনা রইলো।

প্রকৃত পাঠকগণ কি চায় সে ব্যাপারে তারা সর্বদা উদাসীন। এমন সাহিত্যচর্চা করে কি লাভ?

এস্টাবলিশমেন্ট বা ''প্রতিষ্ঠান'' নামক বিষয়টি সরল ভাষায় কবি মলয় রায় চৌধুরী বলেছেন যে, “এস্টাবলিশমেন্ট শব্দটির বাংলা ''প্রতিষ্ঠান'' কেন যে করা হয়েছে কে জানে? এস্টাবলিশমেন্ট বলতে কোন প্রতিষ্ঠান বোঝায় না, অরগানাইজেশন বোঝায়। এস্টাবলিশমেন্ট একটি অ্যাবস্ট্যাক্ট ব্যাপার। প্রতিষ্ঠান শব্দটি দ্বারা ঠিক খোলাসা হয় না। এস্টাবলিশমেন্ট এর টোটাল পাওয়ার স্ট্রাকচার এর বিরোধীতা করলেই বিপদ ঘনিয়ে আসবে। জেলে পুরে রাখবে, নাই করে দেবে। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা করলে আর কী করবে? কিছুক্ষণ চেচামেচি করবে। এস্টাবলিশমেন্ট হচ্ছে সিস্টেমেটিক পাওয়ার স্ট্রাকচার, একটা সমাজের। এসটাবলিশমেন্ট বলে একটা অ্যাক্ট আছে যা দোকান খোলার জন্য প্রয়োজন হয়। ঐ টা ট্রান্সলেট করার সময় প্রতিষ্ঠান আইন করা হয়েছিল, তা থেকেই শব্দটি এসে গেছে। সে যাই হোক, আমি অনেকের সঙ্গেই আলাপ করেছি শব্দটি নিয়ে। কেউ বলেছেন, ব্যবস্থা, ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা, আসলে স্পেসিফিক শব্দ তৈরি হয়নি এখনও।”(২)

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এর ভাষায়- পশ্চিম বাংলায় চারটি পাওয়ার স্টেশন আছে। ঐ চারটি মিলিয়ে হলো এস্টাবলিশমেন্ট;-
এক. পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
দুই. আনন্দবাজার।
তিন. রামকৃষ্ণমিশন।
চার. ব্রাহ্মণ সমাজের ঘাটি শান্তিনিকেতন- বিশ্ব ভারতী।
এই মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্টাবলিশমেন্ট।(৩)

সাহিত্য কেবলি নান্দনিক তৎপরতা নয়, অধিকাংশ সময়ে সে রাজনৈতিক ও দার্শনিক তৎপরতাও। এই নান্দনিক-দার্শনিক তৎপরতার একটা পরিষ্কার চেহারা আমরা বিশ্বের সকল সাহিত্যে দেখি। ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিকতাবাদ, মেটাফিজিক্যাল কবিতা, ফরাসি সাহিত্যে প্রতীকবাদ, গোটা ইউরোপ জুড়ে আধুনিকতাবাদ, উত্তর আধুনিকতাবাদ, ডাডাইজম, পরাবাস্তবতাবাদ, চেতনা প্রবাহ, ল্যাতিন আমেরিকায় জাদুবাস্তবতাবাদ, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে নেগ্রিচিউড, আমেরিকায় বিট আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন মুভমেন্ট বা তৎপরতার মূল প্রণোদনা হচ্ছে নতুন কিছুর সৃষ্টি। এর গভিওে প্রবেশ করলে সাহিত্যের দুটো চেহারা পরিলক্ষিত হয়, প্রথমত ফরমায়েশী সাহিত্য বা বাজারি পণ্য সাহিত্য, দ্বীতিয়ত প্রতিষ্ঠান বিরোধী সাহিত্য বা পুঁজিবাদ বিরোধী সাহিত্য। যেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রথা ও পুঁজিবাদ বিরোধী লিটিল ম্যাগাজিনে।

লিটিল ম্যাগাজিনই তৈরি করে দেয় সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি। সাহিত্যে যত ধরনের আন্দোলন হয়েছে, যে-আন্দোলনকে বলা যায় সাহিত্যেরই প্রাণশক্তি, নতুন নতুন ভাবনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সাহিত্য এভাবে যে এগিয়ে চলে, নবাায়িত হয়ে ওঠে, লিটিল ম্যাগাজিনই সেই আন্দোলনে পুরোধা ভূমিকা পালন করে চলেছে।

এটা সত্যি যে লিটলম্যাগাজিন আন্দোলন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। পাশাপাশি এটাও বলা যায় যে, লিটলম্যাগাজিন ইতোমধ্যে প্রতিবাদী, নিরীক্ষাধর্মী আর তেজোদীপ্ত ভিন্নধারার লেখকগণের পূর্ণ আশ্রয়স্থল রূপে বিশ্বস্ততা অর্জনে সক্ষমতা লাভ করছে। সুতরাং লিটলম্যাগাজিনকে এক্ষণে শুধুমাত্র সাহিত্যের বীজতলা বা সূতিকাগার হিসেবে দেখার কোনো অবকাশ নেই, কেন না আমাদের এই বাংলাদেশে এরই মধ্যে সংখ্যায় কম হলেও একদল লেখক প্রতিষ্ঠান আর বাজার চলতি মিডিয়াকে প্রত্যাখ্যানের বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে শুধুমাত্র লিটলম্যাগাজিনেরই তাদের ক্ষুরধার ও দুর্বিনীত লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন, হ্যাঁ আপাতভাবে এটিই সত্যি।

তদুপরি দুর্জনের কি ছলের অভাব হয়? লক্ষ্য করলেই দেখবেন লিটল ম্যাগাজিনের নাম ভাঙিয়ে সব সময় কিছু কিছু সাহিত্য সংকলন নির্লজ্জ স্ববিরোধিতায় ক্লিশে পণ্য সাহিত্যের লেজুড়বৃত্তি করে চলছে। এই ক্যারিয়ার সচেতন কূপমুন্ডক ধান্দাবাজ বিভীষণেরা মূলত লিটলম্যাগাজিন ও তার মুভমেন্টের অর্জনকে সুকৌশলে আত্মপ্রতিষ্ঠার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহার করে থাকে, ফলত ঐ সাহিত্য সংকলনসমূহ নানান প্রতিষ্ঠান ও দৈনিক তথা পণ্য সাহিত্যেরই লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত থাকে। মজার বিষয় হচ্ছে যিনি দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক তিনিই আবার লিটল সাইজ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদকও বটে! হ্যাঁ, ধান্দাবাজিটা পরিষ্কার বুঝতে আদৌ অসুবিধে হয় না।

সাহিত্যপত্রের ক্ষেত্রে থাকে না কোনো রুচির বাধ্যবাধকতা, থাকে না কোনো সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের বিধিনিষেধ। পান্ডিত্য বা বিশেষ েেকানো বৌদ্ধিক ভাবনার দাস নন লেখক, লেখকের দায়বদ্ধতা তার নিজের কাছে, নিজের রুচির কাছে। পাঠকের কাছে।

কারো ‘মন জোগানো’ নয়, ‘মন জাগানোর’ দিকেই এই পত্রিকার নজর থাকে। চাইলেই চট করে এই পত্রিকা হাতের কাছে পাওয়া যায় না। এই পত্রিকা ভরা থাকে সীমিত সংখ্যক সুনির্বাচিত রচনায়। এর পাঠকেরাও রুচিশীল, রেলস্টেশনে বা ফুটপাথে ভরা সহজলোভ্য লেখা পড়তে তারা অভ্যস্ত নন। আয়তনে যা-ই হোক, রুচির দিক থেকে এই লিটিলম্যাগ মুভমেন্টের বিশেষত্ব আছে।

এই পত্রিকার প্রভাব এতটাই দূরসঞ্চারী হয়েছে যে এখনও এর প্রকাশনা অব্যাহত আছে।
নিজেদের কথা বলা আর সৃজনী আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনে বাংলা ভাষাতেও আধুনিক কালে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর অনেকগুলোই, আজকে আমরা যাকে লিটিল ম্যাগাজিন বলে চিহ্নিত করি, সেই লিটিলম্যাগ মুভমেন্টের বর্ননা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

আবার কেউ কেউ লিটিলম্যাগ কে প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে হয়ে গেছেন পুজিঁবাদের বরপুত্র।
উদাহরন স্বরুপ ঃ
প্রথম বাংলাদেশের কবিরা দার্শনিক বোঝাপড়া হাজির করবার মাধ্যমে কবিতা লিখতে এলেন। অবশ্য এই ইশতেহার যত না দার্শনিক এবং ব্যাখ্যামূলক, তারচে’ কাব্যিক এবং অলঙ্কারমূলক। তবু যতটুকু আভাস মেলে, তাতে বোঝা যায় ‘গান্ডীব’ একধরনের তীব্রতা চেয়েছেন কবিতার মধ্যে, যা দেশকালের ঊর্ধ্বে এক বিশুদ্ধ নান্দনিক জগতে নিয়ে যাবে পাঠককে। তারা সুন্দরকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার কথা ভেবেছেন, প্রয়োজনে ব্যাকরণ অগ্রাহ্য করতেও রাজি ছিলেন। দ্বিতীয়ত, স্বৈরাচার আমলের শ্লোগান সর্বস্ব রাজনৈতিকতার ডামাডোল থেকে বিশুদ্ধ কবিতার দিকে যাওয়ার এই দশাটিকে তারা নাম দিয়েছিলেন ‘সমগ্রবাদী কবিতা’ বা ‘টোটাল পোয়েট্রি’।

বাংলাদেশের সাহিত্যে শুরু হয় আশির মাঝামাঝি থেকে। সেটাও কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরে। এদের মধ্যে, ‘গান্ডীব’ শুরু করেছিল বেশ আঁটোসাঁটোভাবে, মেনিফেস্টো বা ইশতেহারসহ। নতুন কবিতার সেই ইশতেহারটিকে তারা নাম দিয়েছিলেন ‘সমগ্রবাদী ইশতেহার’। সেখানে তারা দাবি করছেন :

১.    প্রচলিত পঙ্কস্রোত থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে।
২.    কবিতার শব্দ হবে এমন, যা পাঠকের চেতনায় আছড়ে পড়বে হাতুড়ির মতো; গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবে চৈতন্যের ইট।
৩.    আমরা এবং একমাত্র আমরাই নির্মাণ করব শব্দের অতিব্যক্তিক সংরক্ত চরিত্র।
৪.    পাঠকের জন্য কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা হবে মৃত্যুযন্ত্রণার মতো। কবিতা শাণিত কৃপাণের মতো ঢুকে যাবে পাঠকের মনোরাজ্যে; আর পাঠক আর্ত ঘোড়ার মতো ছুটতে ছুটতে দেশকাল পেরিয়ে পৌঁছে যাবে এক আতীব্র বোধের চূর্ণিত জগতে।
৫.    থুতু ছুড়ি তথাকথিত সুন্দর ও কুিসতের স্থূল কাব্যবন্দনায়। কেবল আমাদের অভিজ্ঞানে রয়েছে রহস্যময় সংবেদনের আবর্ত।
৬.    এইমাত্র জন্মান্তর ঘটেছে প্রাজ্ঞ অশ্বত্থের, তার অনন্ত শিকড় শুষে নেবে প্রতিটি রসকুম্ভের আত্মা আর তার মহাবিস্তৃত প্রশাখার করতল অধিকার করে নেবে সমগ্র বিশ্ব এবং অবিশ্বকে।
৭.    চাই চামড়া ছাড়ানো দগদগে আদিমতা আর রক্তের ফেনময় ঘূর্ণিনাচ।
৮.    ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাকরণ আগ্রাহ্য করে কবিতায় প্রয়োগ করতে হবে বিন্দুবাদী প্রক্রিয়া।

যে ইশতেহার এ স্বাক্ষরকারী তিন কবির একজন কবি সাজ্জাদ শরিফ বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দৈনিকের বিশেষ সময়িকী সংখ্যার সম্পাদনা নিয়মিত করছেন নির্লজ্জ বেহায়ার মত।

স্বাক্ষরকারী তিন কবিঃ কবি শোয়েব শাদাব,কবি শান্তানু চৌধুরী,কবি সাজ্জাদ শরিফ। যা প্রকাশিত হয়েছিল
(অনিন্দ্য / সংখ্যা ৩ / জুলাই-সেপ্টেম্বর / ১৯৮৫ ও গান্ডীব / সংখ্যা ১ / ফেব্রূয়ারি / ১৯৮৭।)(৪)

উল্লেখযোগ্য শুধু কবি সাজ্জাদ শরিফ নয়, বাঘের বাচ্চা হতে বেড়ালের বাচ্চা হয়ে যাওয়া “প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সামাজিক নৃতাত্ত্বিক কেন্দ্র” শীর্ষক লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ যিনি তার গদ্যের শুরুতেই লিখেছিলেন, “বাণিজ্যপ্রবণ মিডিয়া সর্বস্ব চালবাজির বিপরীতে সঠিক কথা উপযুক্তভাবে প্রকাশের যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা নির্ভর তৎপরতা পাঠকের রুচি পাল্টে দেবার জন্য সাহসী উপায় বলেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনের সূত্রমুখ লিটল ম্যাগাজিন। এদের পথ অনুস্মরণকারী রথো রাফি, মজনু শাহ, ব্রাত্যু রাইসু,পাবলো শাহী, সৈকত হাবিব,আরোণ্যক টিটো, সাম্য রাইয়ানরা সহ আরো অনেকে লিটলম্যাগাজিনের মৃত্যু ঘোষণা করেছে! এইসব বাজারি মালদের জন্ম দেবার ক্ষমতা কি আছে? যে লিটলম্যাগাজিনের মৃত্যু ঘোষণা করেছে! হাসি নয় করুনা হয়।  যাদের নাম লিখতে ঘেন্নাও করে। এদের উদ্দেশেই আহমদ ছফার এই উক্তিটি প্রযোজ্য, “শুকরের বাচ্চার যখন নতুন দাঁত গজায় তখন বাপের পাছায় কামড় দিয়ে পরীক্ষা করে দাঁত শক্ত হয়ছে কিনা।" ।

কিন্তু ছোটকাগজ প্রকাশের সবচেয়ে বড় গরিমা এ-ই যে, সে এমন সব লেখা ছাপাতে তৎপর যা বিদ্যমান স্থিতি অবস্থা/স্ট্যাটাস-ক্যু গ্রহণে অক্ষম বোধগম্য কারণেই। নিছক ছাপাছাপির স্তর ছাপিয়ে উঠে সেই সমস্ত লেখা স্থিতাবস্থার কর্ণমূল ধরে টান দিতে সক্ষম, ঝাঁকুনি দিতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক হেজিমোনির হায়ালজ্জাহীন শরীরকান্ডে, সর্বোপরি শিল্পমূল্যাঙ্কন তথা সাহিত্যের নন্দনগত পরিপুষ্টিবিকাশ বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, পুঁজি তথা কর্পোরেট ক্যাপিটালইজম  প্রতিহতকরণের বিরুদ্ধে উচ্চক্বিত প্রতিবাদ। নিজেদের পত্রিকায় লুটেরা ধনিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বর্জন। প্রয়োজনে, এবং একসময় এইটিই হয়ে ওঠে একমাত্র পথ, নিজেদের তথা সম্পাদকের নিজের ফিন্যান্সে ঝলমলে লেবাস ও অকুণ্ঠ অতিকায় অবয়বে ম্যাগাজিন প্রকাশ। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠান ও পণ্যায়ন প্রতিরোধী নিরীক্ষাপ্রবণ লেখা লালন, অনুশীলন ও প্রকাশ।

সুবিমল মিশ্র এর ভাষায় বড়কাগজের চরিত্র, ‘প্রতিষ্ঠানের প্রভাব এমন গভীর ও নেপথ্যচারী যে খুব কম সাহিত্যিকের সম্ভব তার গ্রাস থেকে রেহাই পাওয়া। প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিশীল, প্রতিভাসম্পন্ন উঠতি তরুণ কবি-সাহিত্যিকের সামনে এক আপাত-দুর্ভেদ্য, অথচ বহু বর্ণ-সমন্বিত মায়াবী রহস্যের দরজা খুলে দেয়, ঝালরি পর্দা দোলায়, তখন খ্যাতির মোহ, অর্থের লোভ, প্রতিষ্ঠার নিশ্চিতি থেকে নিজেকে নিরাপদে সরিয়ে রাখা সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।’

“প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, “সাধারনত প্রতিবাদ মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্থিও, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক।”

অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ঘটে এই লেখকদের উত্থান, “প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবই সাহিত্যের জাগরণের ধর্ম।” প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাই ছিল ওই সময়ের বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যের বিষয়ভাবনা ও প্রকাশশৈলীতেও ঘটে যায় মৌলিক পরিবর্তন। এই ধারাতেই প্রকাশিত হচ্ছে অসংখ্য লিটিলম্যাগ।

তাইতো সুবিমল মিশ্র বলেছেন, “প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান”।

বাজারি পণ্য সাহিত্যেও লেখকগণ কথাটার মানে না বুঝেই তারা প্রতিষ্ঠানমূখী হচ্ছে অথচ প্রতিষ্ঠিত শক্তির মানে সৃজনশীল ব্যক্তি, যিনি বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদকে না বলে বাজারি সাহিত্যের বিপক্ষে দাড়িয়ে নিজস্ব চৈতন্যের বিকাশ, নতুন কিছুর পরীক্ষা-নীরক্ষিা প্রবণতাকে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে তার সাহিত্যকর্মকে দাড় করিয়ে অনিবার্যভাবে আবিস্কারের নেশায় লিপ্ত রয়েছেন।

সুবিমল মিশ্র এর ভাষায়, “লোকে যাকে সাহিত্য করা-টরা বলে তেমন কিছুতে আমার আস্থা নেই। চীন্তার মধ্যবিত্ততাকে আমি ঘৃণা করি, যে চীন্তা বৌয়ের ঠোঁটের লিপিষ্টিক দেখে রক্ত প্রত্যক্ষ্য করে। রবিঠাকুর-টাকুরদের মতো সাহিত্য করিয়েদের লাইনে থাকতে রীতিমত অসম্মানিত মনে হয় আমার। আমি তেমন কোন লেখা লিখতে চাই না যা পড়ে লোকে আমার পিঠ চাপড়ে বলবে, বাহ বেড়ে সাহিত্য করছোতো হে ছোকরা, আমি চাই লোকে আমার লেখা পড়ে থুথু দিক, আঙুল দেখিয়ে বলুক ;- এই সেই লোক যে উপদংশসর্বস্ব এই সভ্যতার ঘাগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনের আলোর মতো খোলাখুলি করে দিয়েছে ।”

সাম্রজ্যবাদিদের অণ্যে পালিত এইসব কর্পোরেট মিডিয়াবাজ কুশিলদের মুখোশ উম্মোচন করা জরুরি কাজ হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। পশ্চাতমুখিতা নয় আগামি পৃথিবীর জন্য আবশ্যক, আগামির জ্ঞান এবং যুক্তিনির্ভর স্বপ্ন প্রকল্প। রাজকুমারের বিরত্ব, রাজকুমারির কথিত প্রেমের জন্য আত্মত্যাগ, আমাদের বেষ্টন করে আছে যে জ্ঞান প্রযুক্তি অর্থনৈতিক শত্রুবলয় তাহার মোকাবেলা কোনো ভাবেই দরবেশের পানি পড়া দিয়া সম্ভব না। জ্ঞানের মোকাবেলা কেবলমাত্র জ্ঞান দিয়েই করা সম্ভব।” আর সেটা করে চলেছে লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট।

আসলে ক্ষমতা আর প্রতিরোধ একে-অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, ক্ষমতা মানে কেবল রাজার শরীর নয়, বরং গোটা সমাজদেহের অণু-পরমাণুতেই চলে ক্ষমতার বিস্তার, উই আর অল কট ইন আওয়ার ওন ওয়েব!

ততোদিন বরং দু-আনা, চার-আনার এঁটোকাটা স্ক্রিবলারের দল আর তাদের ততোধিক এঁটো দালালসমূহ খেলাধুলো করুক, ঘৃণা এবং যুদ্ধ প্ররোচিত করার জন্য শান্তি ও প্রেমকে প্রচার করে।

২.

আমাদের সমাজে বাড়তি মুল্য যতবেশী হয়, পুঁজিপতিদের মুনাফাও হয় ততবেশী। এই মুনাফালোভীরা সাহিত্যকে পুঁজি বিনিয়োগ এর  মাধ্যম বানিয়ে তথাকথিত বুঁর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদীরা নানান মোড়কে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে সুভিধাবাদী বাজারি, অর্থলোভী, প্রচারমুখি, স্বঘেষিত আঁতেল শ্রেনীকে নিয়ে ফরমায়েশী ব্যক্তিদের দিয়ে সাহিত্যেকে বাজারি প্রসাধনী পণ্য বা প্রডাক্ট সৃষ্টি করেছে। বাংলা সাহিত্যের মৌলিক চেতনাকে বাদ দিয়ে লেখক সত্তার স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে সাহিত্যে লেখক নামক কেরানী তৈরি করে চলেছে নিরšতর। না আছে এই সব লেখকদের প্রকৃত সাহিত্য সৃষ্টির প্রতি কোন কমিটমেন্ট, না আছে কোন পাঠককূলের নিকট কোন দায়বদ্ধতা। এই সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ফরমায়েশী লেখকদের লোভী কালোহাতে কলুষিত হচ্ছে এ দেশের সাহিত্য। এজন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে ফরমায়েশী লেখকদের সৃষ্ট বাজারি পণ্যের কবল থেকে প্রকৃত সাহিত্য সৃষ্টির রক্ষাকরা।

যিনি প্রকৃত সহিত্য অনুরাগী ও মৌলিক সহিত্যচর্চার প্রতি দায়বদ্ধ, তিনি বা তারা স্বাধীন সত্তা নিয়ে আপোষহীন ,তাই তাঁরা নিজস্ব মৌলিক চীন্তা করতে পারেন আর সৃজন করেন  তাদের সকল সৃষ্টিকর্ম। প্রচলিত এই সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ফরমায়েশী বাজারিদের বিরুদ্ধে  দ্রোহ করেন, বিরোধীতা করেন , প্রথাভেঙে লড়াই করে চলেছেন এই বাজারি সাহিত্য নামক অপসাহিত্যের “ লিটিল ম্যাগাজিনগুলোর জন্ম কোনো একটা আদর্শগত প্রতিজ্ঞা নিয়ে, প্রতিবাদ, ভাঙচুর, বিদ্রোহ, আন্দোলন, মোট কথা সাহিত্যে একটা নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে আসা একটা সর্বাঙ্গীন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে। এঁদের পাঠক নির্বাচিত এবং বয়স্ক ।”

আাগ্রাসন হতে বাংলা সাহিত্য, সাহিত্যিক এবং পাঠকদের বাঁচাতে।

বর্তমানে চীন্তায় মধ্যবিত্ততাকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠিত কিছু প্রতিষ্ঠান সাহিত্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের জন্য এক শ্রেনীর ফরমায়েসী সাহিত্যি ও অর্থলিস্পু খ্যতিকাতর সাহিত্যিকদের সচেতনভাবে তৈরি করেছেন। বাজারি পাটাতনে কলাকৈবল্যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উৎপাদকের ভূমিকায় রেখে ফরমায়েসী অর্থলিস্পু খ্যাতিকাতর সাহিত্যিকদের চীন্তার মধ্যবিত্ততাকে বানিয়েছে উপকরণ, তাদের ফরমায়েসী সৃষ্টকর্মই হচ্ছে উৎপাদিত প্রডাক্ট বা পণ্য। এই প্রডাক্ট বা পণ্যকে পাঠক গ্রহন করুক আর নাই করুক সেটা তাদের মাথাব্যথা নয়, বরং নানান ষ্টাইলে রঙঢঙে ঢাক পিটিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করে পাঠকে জোর করে এই প্রডাক্ট বা পণ্যকে গেলানোর নতুন নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করছে । বিভ্রান্ত পাঠক কেউ গিলছে না কিন্তুু বেশীরভাগ পাঠক মৌলিক সাহিত্যিক্ষুধা মেটাতে না পেরে বিমূখ হচ্ছে। তবে এত বাজারি পাটাতনে কলাকৈবল্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত প্রডাক্ট বা পণ্য কে সাহিত্যিকদের চীন্তার মধ্যবিত্ততাকে বজর্ন করে সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠকগণ ঠিকই খুঁজে নিচ্ছে ১৯৬৫ সনে হাংরি বিলুপ্ত হবারপর লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট এর প্রথাবিরোধী কাগজগুলোর সাহিত্যকে। যদিও লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট এর প্রথাবিরোধী কাগজগুলোর কোন প্রচার নেই তারপরও, কারন এই সময় ও সভ্যতার ঘাগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিনের আলোর মতো খোলাখুলি করে দিচ্ছে।


" ছোটোগল্পের জন্যে ভরসা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিনের ওপর । প্রচলিত রীতির বাইরে লেখেন বলেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের দরকার হয় নিজেদের পত্রিকা বের করার । বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় ছোটোগল্পে নতুন তরঙ্গ অনুভব করা যায় প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনেই । তাদের লেখায় ছোটোগল্পের ছিমছাম তনুখানি অনুপস্থিত, সাম্প্রতিক মানুষকে তুলে ধরার তাগিদে নিটোল ছেড়ে তারা তৈরি করছেন নানা সংকটের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ছোটোগল্পের খরখরে নতুন শরীর । এইসব লেখকদের অনেকেই অল্পদিনে ঝরে পড়বেন, সমালোচকদের প্রশংসা পাবার লোভ অনেকেই সামলাতে না পেরে চলতে শুরু করবেন ছোটোগল্পের সনাতন পথে । "
(সংস্কৃতির ভাঙা সেতু-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস)।(৫)

"আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেইসব সাহিত্য যা মানুষ উপভোগ করে এবং জীবনের বিরুদ্ধে অপরাধ করে আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেই কবিত্ব যা হিজড়ের শীৎকার ছাড়া আর কিছু নয় আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেই ন্যাবা ধরা ভাষা যা আজকের ভয়ার্ত আত্মাকে আমূল ঝাঁকায় না আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেই কবিতা যা মানুষকে শব্দের খোঁয়াড়ে বন্দি করে রাখে অভিজ্ঞতাকে মুক্তি দিতে জানে না । " শৈলেশ্বর ঘোষ-(এই অংশটি শৈলেশ্বর ঘোষ-এর "উৎসব" কাব্যগ্রন্থের ব্যাক কভারে আছে ।)(৬)

 এই উপমহাদেশের তিনজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক- শৈলেশ্বর ঘোষ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সাদাত হাসান মান্টো; যারা ভাষার ভেতর অন্তর্ঘাত চালিয়ে তেঢ্যামনা হাড় হারামি মধ্যবিত্তের পোঙায় আছোলা বাঁশ ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

যা আমরা  লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট এর একরকমের ইশারা হিসেবে ধওে নিতে পারি।

শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তা সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্ষে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধার্ত।

‘সমাজের প্রশ্ন থাকলে দায়ের বোধও থাকবে। কোথায়? যেখানে দায়বোধটা প্রত্যেকের মধ্যে একইরকমভাবে ক্রিয়া করবে, সেখানেই তো; কোন সে সমাজ? যেখানে মানুষ যে কিনা কোনো কাজের জন্যে কেবল এককভাবেই দায়ী। অন্তত এই সমাজে না। তার সম্পন্ন-সত্তার একক কীই-বা? এই যে প্রাইভেসি আর পারসোনাল নিয়ে কতো বিতর্ক; মানুষের সৃজনকর্মেও সময়টুকু ছাড়া আর বর্জ্য-পরিহারের সময়টুকু ছাড়া, তার প্রাইভেসির কতটুকুই-বা প্রয়োজন?’
এই অংশটি - সেলিম মোরশেদ  এর উপন্যাস সাপলুডু খেলা এর ব্যাক কভারে আছে। (৭)

৩.

এরপর বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে কল্লোল যুগ এর সাহিত্যিকগণ রচিত সাহিত্যকর্মগুলো তৎকলীন ভারত ঔপনিবেশিক আন্দলোনে আপামর সাধারন মানুষের নিকট  বৃটিশদের ভারতবর্ষ হতে তাড়াতে তাঁদের সাহিত্য লড়াইয়ের অস্ত্রের মত শাণিত হয়ে উঠেছিলো। এরপর ধর্মের ভিত্তিতে ১৪ই আগষ্ট রাত বারোটায় অর্থাৎ ১৫ই আগষ্ট, ১৯৪৫ সনের প্রথম প্রহরে যা এই পৃথিবীতে বিরল দ্বীজাতি তত্ত্ব তথা ধর্মীয় মৌলবাদী প্রহসন জন্মের মাধ্যমে একটাই বাংলা বৃটিশ আইনজীবি রেড ক্লিফ সাহেব ছুরি চলিয়ে দ্বীখন্ডিত করলো আর আমরা বাঙালী হিসাবে নয় মুসলিম হিসাবে স্বাধীন পাকিস্থান এর অংশ হলাম। আমাদের নামকরণ করা হলে পূর্ববাংলা আর অপর আংশে হিন্দু হিসাবে স্বাধীন ভারত এর অংশ হলাম। আমাদের নামকরণ করা হলো পশ্চীম বাংলা। লাখো লাখো মানুষের দল আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা, শিশু অর্ধাহারে অনাহারে হেঁটে, গরুর গাড়ীতে চড়ে যশোর রোড দিয়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেলেন পশ্চীম বাংলায়। তারা বাঙাল পরিচয়ে নতুন করে জীবন শুরুর সংগ্রামে মেতে উঠলেন।

কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠী সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক নবজাগরণের সূচনা করে।বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাতে এই আন্দোলনের ভূমিকাই মুখ্য বলে বিবেচিত।১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসু প্রমুখ কলকাতার হাজরা রোডে “চার শিল্পীর গোষ্ঠী” নামে একটি আড্ডার সূচনা করেন, সাহিত্য, ললিত কলা, সংগীত ও নাটক সৃষ্টি ও চর্চার জন্য। প্রথমে চার সদস্য একটি ছোটগল্পের সংকলন বের করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে , নাম ঝড়ের দোলা। দীনেশরঞ্জন দাশ এবং গোকুলচন্দ্র নাগ এরপর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি সাময়িক পত্র বের করেন, নাম দেন কল্লোল।

কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ১৯২৩ থেকে ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দ কাল পরিধিতে বাংলা সাহিত্যে প্রভাবশালী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। কল্লোল সাহিত্য পত্রের সময়কালকে কল্লোল যুগ হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কল্লোল নব্য লেখকদের প্রধান মুখপাত্র ছিল যাঁদের অন্যতম ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু। অনান্য সামযয়িক পত্রিকা যেগুলো কল্লোল পত্রিকা কে অনুসরণ করে সেগুলো হলো উত্তরা (১৯২৫), প্রগতি (১৯২৬), কালিকলম (১৯২৬) এবং পূর্বাশা (১৯৩২)।(৮)

তার সম্পাদক গোকুলচন্দ্রের মৃত্যুর পর কল্লোল শেষ হয়ে গেল। কল্লোল শেষ একটি জার্নাল শেষ না শুধুমাত্র একটি যুগের শেষ ইঙ্গিত। সাত বছর কলেরোল যুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করা হয়েছে - বাঙালি আধুনিকতাবাদ দ্বারা চিহ্নিত একটি অধ্যায় দিয়ে।

দেশভাগের সময়কার অবস্থায় কল্লোল যুগের পর বাংলা সাহিত্যে সময়ের তাগিদে সৃষ্ট আন্দোলনের কথা সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের ভাষায় বর্ননা করা যায়, “কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার সেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল যে বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রচলিত সংস্কৃতির কাউন্টার ডিসকোর্স পরিবর্তনের আন্দোলন - হাংরি জেনারেশন।

হাংরি জেনারেশন আন্দোলন বাংলা ভাষায় একটি তৎকালীন ভারতীয় সাহিত্য আন্দোলন ছিল যা মূলত কবিতার ওপর আলোকপাত করে এবং বিখ্যাত বঙ্গীয় চার্চ দ্বারা পরিচালিত তরুণ বাংলা কবিদের একটি গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত হয়, যেমন মালয় রায় চৌধুরী, সামির রায় চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এবং দেবী রায় (হারধন ধারা)। এটি কলকাতা, ভারততে ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে চালু হয়েছিল। এই আন্দোলনটি ভারতে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিকড় কেটে দিয়েছে। সমসাময়িক ভারতীয় সাহিত্যে ব্যবহৃত ভাষা এবং শব্দভান্ডার চ্যালেঞ্জ এবং উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়।

এই আন্দোলন প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং কখনও কখনও বীরংঃবহঃরধষরংস এর ঃবহবঃং অভিব্যক্তি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে কলকাতায় অবস্থিত, যদিও এটি উত্তরবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বেনারসে সক্রিয় সদস্য ছিল। মুলত এই আন্দোলনটি অ্যালেন গীন্সবার্গ্র সহ আমেরিকান কবিদের বীট জেনারেশন দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
ক্ষুধার প্রজন্ম আন্দোলন নামেও পরিচিত ঐঁহমৎুধষরংস মূলধারার সাহিত্য শৈলীর চ্যালেঞ্জ গ্রুপটি শৈলী, ফর্ম এবং বিষয়বস্তুতে একটি প্রধানত ফবারধহঃ কবিতা এবং গদ্য রচনা করেছে। এটি হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, তেলেগু ও উর্দু সাহিত্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।(৯)

সমাজের বৈষম্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় যা দ্বন্দ সৃষ্টি করে, এর পরিবর্তে যা আদেশ ও ঐক্যমত্য তৈরি করে। বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে এই দ্বন্দটি কেবল সমাজের বিদ্যমান সর্ম্পকেমৌলিক রূপান্তর, এবং নতুন সামাজিক সর্ম্পকের ফলদাক হয়ে উঠতে পারে। হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হযয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পডয়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যাযয়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তাঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স সৃষ্টি করতে পেরেছিল।

বাংলা সাহিত্যের নামে বর্তমান সময়ে যা হচ্ছে পশ্চীমবঙ্গের মতই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির ছত্রছায়ায় তা নোংরামীর একরকম চুড়ান্ত পর্যায় পৌছেছে। বাজারি পণ্য সাহিত্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, লেখকদের সৃজনশীলতা, চৈতন্যের বিকাশ, নতুন কিছুর পরীক্ষা-নীরক্ষিা প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করছে। লেখক সত্তার নিজস্ব চীন্তাচেতনার  অনুভুতিকে প্রতিবন্ধি করে রেখেছে।

হাংরি আন্দোলন বিলুপ্ত হবার পর এক ধরনের সাহিত্যচর্চায় শুন্যতা পাশাপাশি বাজারি সাহিত্যের প্রভোক ও আপদকালীণ সময়ে বাংলা সাহিত্যে কবিতা নিয়ে নীরিক্ষার অন্যতম উদাহরন ও প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার ইশারা ছিল যেন,
কবি বিনয় মজুমদার অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে কবিতায় তুলে ধরেছেন তার যাপনের নানা অভিজ্ঞতা, আশা-ব্যর্থতা, অনুরাগ, অপ্রাপ্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ- যা জীবনানন্দের মৌনতাকে সমর্থন করলেও বিনয়কে চিনতে বেগ পেতে হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে, বিনয়ের কবিতাগুলো যেন স্বগতোক্তি কিংবা আত্মকথন, যা শান্তরস সিক্ত, তীব্র ব্যঞ্জনাধর্মী ও গভীর অর্থবোধক। এ বৈশিষ্ট্যের কবিতাকে কাব্যবোদ্ধারা আত্মমুখিনতা বা ইন্ট্রোভার্ট কবিতা বলে আখ্যায়িত করেন।

সেই আপদকালীন সংকটময় সময়ে কবি বিনয় মজুমদার কাব্যিক শুন্যতার মুহূর্তে কবিতার প্রচলিত ফর্ম ভোঙেন এবং আবিস্কার করেন নতুন কাব্যলৈী যাকে তিনি ইন্ট্রোভার্ট কবিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তার ‘একটি গান’ কবিতাটির পাঠ নেয়া যাক-

‘ঢ = ০

এবং ণ = ০

বা ঢ = ০ = ণ

বা ঢ = ণ

শূন্য ০ থেকে প্রাণী ঢ ও ণ সৃষ্টি হলো

এই ভাবে বিশ্ব সৃষ্টি শুর হয়েছিল।’

‘একটি গান’ কবিতায় বিনয় মজুমদার ‘সৃষ্টির উৎস’ অšে¦ষণের চেষ্টা করেছেন, কবির ভাষায় শূন্যবিন্দু থেকে। মূলত সৃষ্টির আধার খুঁজতেই কবি গাণিতিক এই ফর্মটির প্রয়োগ ঘটিয়েছে। বাংলা কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও বিনয়ের আগে কোনো কবি প্রয়োগ করেছেন বলে জানা যায় না। আবার ‘সৃষ্টির উপায়’ কবিতায় তিনি বলেন-

অপরদিকে, ঘৃণা এবং যুদ্ধ প্ররোচিত করার জন্য শান্তি ও প্রেমকে প্রচার করে, “ “প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, “সাধারনত প্রতিবাদ মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্থির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক।”(১০)

কিন্তু বিগত চার-পাঁচ দশকের বাংলা কবিতার ইতিহাস প্রমাণ করেছে, মধ্যমেধা আর নিম্নমেধার ছড়াকার-গীতিকার নয়, বাংলা কবিতাটা আসলে শাসন করে এসেছেন আলোর বৃত্তের বাইরে থাকা বাঘ-সিংহেরাই। এরা আজ সসম্মানে পুনর্বাসিত হচ্ছেন এবং আরও হবেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের হিম্মত হবে না এদের মুছে দেবার! ততোদিন বরং দু-আনা, চার-আনার এঁটোকাটা স্ক্রিবলারের দল আর তাদের ততোধিক এঁটো দালালসমূহ খেলাধুলো করুক।

“একজন যিনি কবি হয়ে উঠতে চান, তার আত্মবিমোচন পদ্ধতি শুরু হতেই যদি বুঝে যান যে তিনি ক্ষমতার বিপক্ষের লোক নন, তিনি ক্ষমতার পক্ষের লোক; তিনি যে ভাষা পেতে চান সেটি ক্ষমতাকে বিরূপ করে তুলবে -- তখন শুরু হয় তার ত্রাসের কাল । ভাষা বিমোচন তো দূরের কথা, এই সংঘর্ষের ক্ষেত্রটি থেকে পলায়নই তার বাঁচার পথ হয় । এমন রচনাকার আমরা দেখেছি যিনি ক্ষমতার ভাষাকে আঘাত করার আপাত একটা মানসিকতা দেখাচ্ছেন কিন্তু অনতিকালেই তিনি ওই পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন । তিনি ঢুকে পড়েন ক্ষমতাসেবীর দলে ।"
-শৈলেশ্বর ঘোষ (ভাষা বিমোচন)।(১১)

“দুরূহ দুর্গম তার যাত্রা, যা কিনা সলোমানের; মূলত অনুসন্ধিৎসু মানসে এক বিন্দু থেকে নব নবতর বিন্দুর দিকে অভিগমন। সকল ঘটনাসংঘঠন সে প্রত্যক্ষ করে নির্বিকার অথচ সূক্ষ্মতর বিশেষে এবং সংলক্ষ্য এও যে সম্পৃক্ত হয় না সে কোনো ঘটনা বিন্দুতেই। ধর্মবোধ-আধ্যাত্মিকতা,সংখ্যাতত্ত্ব আর রাজনৈতিক চেতনা ব্যাংগমা-ব্যাংগমীতে দ্বন্দমুখর একটি চেতনা,সলোমানের,ততসহ আর সব ক্যাটালিস্ট চরিত্রগুলিও। এই যে সলোমান,তার যাত্রা কি কেবলই সম্মুখবর্তী? নিঃসংশয় কি সে? ক্বচিত পিছন মুখে তাকিয়ে কি সে ক্ষণকাল ভাবিত হয়?এমতো যে,আমার ভালোভাবে-বেঁচে-থাকা জীবনে যা আমি অন্তরংগে দেখলাম,এই পর্যবেক্ষণ,তা সততার সংগে ব্যক্ত করলাম,ব্যাস, এপর্যন্তই।পাঠক,সলোমান বা তার মতো,এই নভেলেটে,' সাপলুডু খেলা' র কোনো স্থির গন্তব্য নেই।এই কথাবস্তুতে সলোমান কেবল ভীত,সৌন্দর্যময় সাপ আর ঘরলুডু'র ভবিতব্যে জড়িয়ে পড়াও একটি চরিত্র।পাঠক, তুমিও তাকে দেখ, যদিও দেখার কোনো দায় নেই। ৮০'র দশকের সবচেয়ে দায়বদ্ধ লেখক সেলিম মোরশেদ 'কাটা সাপের মুন্ডুু'র পর তার এই নভেলেটে বিগত দিনের গল্পধারার বাইরে এই প্রথম কথ্যভাষার সারল্যে পরস্পরবিরোধী এমন একটি ব্যতিক্রম, আন্তর্জাতিকতাময় আর স্পর্শকাতর বিষয়কে তার কথাবস্তুর উপজীব্য করলেন।”
এই অংশটি - সেলিম মোরশেদ  এর উপন্যাস সাপলুডু খেলা এর ব্যাক কভারে আছে। (১২)

লিটিলম্যাগ কেন্দ্রিক বহুবিধ ধারণাপোষণ করে এসকল ছোটকাগজের সঙ্গে যারা জড়িত তারা কি শুধু সম্পাদকের দযিত্ব পালন করছেন না সংগ্রাহকের? কতোটা মৌলবাদ বিবর্জিত? আদৌ কি লিটলম্যাগ হয়ে উঠছে নাকি নানা রকমের লেখকদের মহাসমাবেশ ঘটিয়ে বিশ্ব এজতেমা সংকলিত করছেন? পেটমোটা সংকলন করে ভলিউমের বাইসেপ, ট্রাইসপ দেখিয়েছে, দেখিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তরর? জিজ্ঞাসা আরো গভীরে প্রোথিত হলে তৃতীয় বাংলার লিটলম্যাগ উভয়বঙ্গে তথা বাংলাভাষাভাষী সর্বঅঞ্চলে চিহ্ন তৈরি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

“হে সৃষ্টিশীলতা, নিজেকে নিজে আক্রমণ করার জন্য তৈরি থেকো”- সুবিমল মিশ্র।

আশির দশকে বাংলাদেশে কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ ও তাঁর সহযোগী সমমনা সাহিত্যিকগণ আমাদের দেশে লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট এর প্রথারবিরোধীতা তথা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার চর্চা ও প্রয়োগ ঘটান। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নায্যতা, এর অনিবার্যতার বিশদ ভাবে তুলে ধরেন তাঁর রচিত পাল্টা কথার সূত্রমূখ এ বিষয়ক ইশতেহার গদ্যে। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, “প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোন খন্ডিত বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ, ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় অবস্থিত নান্দনিক ধারণার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও আক্রমণ। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অর্থই আমার শিল্প বিশ^াসকে এমন পর্যায়ে নিতে হবে যেক্ষেত্রে পণ্য সর্বস্ব পত্রিকাগুলি লেখকের জীবনের কোন পর্যায়ে তাঁর লেখা ছাপার জন্য, তারা (প্রতিষ্ঠান) শেষ সাহষটুকু নিয়েও এগোতে পারবে না।” তিনি আরো বলেন, “'অদৃশ্য সূত্রে কিছু লেখকের মননের একটা ঐক্য হয়। ইংরেজি থেকে ধার করে বলতে হয় -- অল্টার ইগো বা বিকল্প অহম; অপরিচিত বহু লোকের কাছে অনেক সময় শোনা যায়, আশ্চর্য, আপনার চেহারাটা আমার পরিচিত একজনের মতো? কোথায় যেন দেখেছি? এইসব দেখাগুলো, মেলামেশাগুলো- পরস্পরের দেয়া-নেয়া। একটা সামষ্টিক আকাঙ্খা - অজানা যূথবদ্ধতা মানুষের ভেতর কাজ করে। তখন মানুষের কীর্তি একক না। সে ঐটুকু ভাগ্যবান, তার ভিতর দিয় কর্মটি প্রকাশিত হয়েছে।

এদের বিষয়ে আরো সতর্কতা এক্ষণে সত্যিই ভীষণ জরুরি। তবে প্রথমেই তাদের চিহ্নিত করতে হবে, তা না হলে লিটলম্যাগাজিন আন্দোলন কিংবা যূথবদ্ধতা সবকিছুই দারূণ ক্ষতির মুখে পড়বে, পড়বেই।
তাই উদ্ভব হলো নতুন এক পরিস্থিতির।

দশক যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তার একটা বিবরণ পাওয়া যায় আশির দশক ও নব্বই দশকের বাংলাদেশের প্রধানতম লিটিলম্যাগুলোর সম্পাদকীয় ও সম্পদকদের লেখায়,(১৩)

সূত্রমুখ: প্রতিষ্ঠান... অপ্রতিষ্ঠান... মধ্যবিত্ত... ছোটকাগজ।
(প্রতিশিল্প ॥ প্রথম সংখ্যা ॥ মার্চ ১৯৯৪)

“সেলিম মোরশেদ: চলমান প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ মিথ্যা, ও আপত নিরাপদ। প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা খন্ডিত বিষয় না বরং তা হচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ, ব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় অবস্থিত সর্বপ্রকার নান্দনিক ধারণার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও আক্রমন।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি চৈতন্যকে প্রমোট করা যাবতীয় নান্দনিক বিষয়কে ভাঙায় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পে প্রকাশ করাই পাল্টা লেখা এবং এই জাতীয় লেখা প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় মাধ্যমই ছোট কাগজ। আর বিরোধিতা-মধ্যবিত্তের নৈতিকতা, অনৈতিকতা তাদের সামাজিক সম্মানিত অবস্থান (অর্থনৈতিক ও মানসিক), আপসকামিতা, রূচিশীলতা, মানবতার নামে বৃত্তবদ্ধ হওয়া-সেন্টিমেন্টাল-চোরাবালি বিরুদ্ধে। কেননা যে শ্রেণির গন্তব্য ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠার গতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যাদের মূল্যায়ন অভ্যস্ত অবস্থানের উপর-তাদের বিরুদ্ধে। ‘ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা’, ‘স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠা’, ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’, ‘শিল্প বিষয়টি ভিন্ন’ এই জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীল বদমাইশদের বিরুদ্ধে শিল্প পুরোপুরি সচেতন প্রয়াস।”
(সম্পাদক: মারুফুল আলম / প্রতিশিল্প, সংখ্যা ৫, এপ্রিল ২০০৩।।)

“পণ্য সাহিত্যের মিডিয়া বিরোধিতার পেছনে প্রতিশিল্পের একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস আছে। কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির আওতাভুক্ত হওয়া বা কারো ইচ্ছা সাপেক্ষে প্রতিশিল্প চালিত হয় না। কিঞ্চিৎ অপপ্রচারটা আমরা শুনি। এর পেছনে কারণটাও আমরা লক্ষ করেছি। আশির সৃজনশীল প্রতিবাদী আত্মনিমগ্ন একজন বিশ্বাসী লেখকের নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায়কে কেন্দ্র করে বড় কাগজ ও তথাকথিত ছোটকাগজের ভেতরে যে আত্মগত সংকটের রূপ আমরা দেখছি তাতে অবাক হতে হয় যে তাদের চিন্তা ও শিল্পপ্রতিভার দীনতা কতখানি নিচে। ছোটকাগজের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যের জায়গাটা তৈরি করা ও কর্পোরেট ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যেখানে রীতিমতো মৃত্যুর সামনে দাঁড়ানো সেখানে কোনো ব্যক্তির বিরোধিতা নিয়ে থুথু ওঠানোর সময় কি আছে? আসলে ভাঁড়ারে মাল নেই তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। দিনভর চাকরি করে দাম্পত্য জীবন সুখের করা কিংবা স্টুডেন্ট ক্যারিয়ার বিল্ডআপ নিয়ে ব্যস্ত থাকা কিংবা এমফিলের প্রশ্নে লিটলম্যাগাজিন করা আর কবি-লেখক হওয়ার রোমান্টিক সংকট থেকে দুটো বই পড়ে উত্তেজিত হওয়া— এই মধ্যবিত্তীয় আত্মগ্লানির বিষ গ্রহণ করতে আমরা অভ্যস্ত না। আমরা সমালোচনা গ্রহণ করবো সেই ব্যক্তির যার প্রকৃত সমাজভাবনা আছে, যোগ্য হয়ে আত্মত্যাগ আছে আর অবশ্যই সেই ব্যক্তির পেশাগত ও অর্থনৈতিক যাপন দেখে— তত্ত্ব, জ্ঞান বা বুর্জোয়া শিল্পকর্ম দিয়ে না। আর আমরা তো জানি জ্ঞান দিয়ে শিল্পকর্ম হয় না।

পাঠক, নানাবিধ সাহায্যকারী ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।

কবি কামরুল হুদা পথিক, সম্পাদক দ্রষ্টব্য, তিনি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বিষয়ে বলেন, “ জোঁক যতই ছোট হোক রক্ত চোষাই তার স্বভাব। সে ক্ষেত্রে পশ্চীম বঙ্গের আনন্দ হোক আর বাংলাদেশের ভোরের কাগজের মদ্ধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।” তিনি আরো বলেন, “কোন কিছুই অনিবার্য নয়, আবার অনিবার্যতার বর্মে আচ্ছাদিত রেখেই এক মজবুত পাটাতনে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে এবং রেিখ একদল লেখক-পাঠক। এ যেনো নিজের সাথে নিজের এক সাংঘর্ষিক প্রক্রিয়া।” তিনি চীন্তায় মধ্যবিত্ততাকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,

“আপনি ইচ্ছে করলে /
জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারবেন /
কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামের /
বুঁনো শুয়োর/
আপনাকে ছাড়বেনা  কারন /
তার ঘি বলেন আর গু বলেন /
কোনটাতেইআরুচি না নেই।(১৩)

তিনি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বিষয়ে দ্রষ্টব্য ১৩ তম সংখ্যায় বলেন,“ পুঁজির আছে সকল কিছু গ্রাসাচ্ছাদি অগ্নিমুখ-লোভাতুর জিহ্বা-ডাইনোসরের উদগ্র স্বেচ্ছাচারী ক্ষুধা নিবৃত্তির কামুক প্রবৃত্তি। আর অসম্ভব অপশক্তির ধারক এই পুঁজিই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মুখ। পুঁজি গিলে খেতে চায় সমাজ-সাহিত্য-সভ্যতা। কষ্টে-শিষ্টে হজম করতে চায় সবকিছু। আর পয়ঃনিষ্কাশনের মতো এক সময় উদগীরণ করে ফেলে দেয় আমিষটুকু চুষে নিয়ে। পুঁজির হাঁ-মুখ থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলে ছোট কাগজের প্রজ্ঞাশীল লেখকরা। কখনও কখনও তীব্র ঘৃণা কিংবা তীব্র বিরোধিতাকেও বেগবান করে তুলে এ সকল লেখকরা। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের পিঠ চাপড়ানি মার্কা কর্মপ্রণালীর পাশে রাজনীতির মাঠে বি-টিমের মতোই বাজারি-বারোয়ারি-বাণিজ্যিক কাগজগুলোর ধ্বজামার্কা সাহিত্যের পাতাটির বি-টিম হিসেবে সাহিত্যের মাঠে অবস্থান করে বড় কাগজের সেবাদাস কিছু ভেকদারী ছোট কাগজ। বড় কাগজের কনটেন্ট জাস্ট ছোট পাতায় প্রিন্ট করে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ থাকে না। নিরীক্ষাতো নেই-ই। ছোট কাগজের আগ্রহ যেখানে এক্সপেরিমেন্ট, বড় কাগজের আগ্রহ সেখানে নিরীক্ষাকে প্রত্যাখ্যান। তাই সব দেশে সবকালে সাহিত্যে সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি প্রবাহমান সেটি হচ্ছে সাহিত্যে কমার্শিয়াল বা বেনিয়াবৃত্তির পাশপাাশি প্রকৃত ও মৌলিক সাহিত্যনির্ভর অবিচ্ছিন্ন এক লিটল ম্যাগাজিনের বহমান স্রোত।”


কারো পরোয়ানা করে নিজের ভাবনা-চিন্তা নিজের মতো লেখা, এটাই লিটল ম্যাগাজিনের মূলধর্ম...

লিটল ম্যাগাজিনস সাহিত্যের ধমনী, লিটল ম্যাগাজিন  অর্থো আন্দোলন। যদি তার মস্তিষ্কে সুদূরপ্রসারী কল্পনা না থাকে? তবে, ঐ কাঁচের ঘরে বনসাই, কী বাহারে লতা হয়ে কী লাভ? বরং পাহাড়ের চূড়ায় বৃক্ষ হওয়া অনেক শ্রেয়। অবশ্য ঘাতকের হাতের কুঠার বা ইলেকট্রিক করাত বুঝিয়ে দেয়, তার স্বল্পায়ু জীবন। একথা প্রায় সব লিটল ম্যাগাজিনের ভবিতব্য। বাংলা সাহিত্যের নামে বর্তমান সময়ে যা হচ্ছে পশ্চীমবঙ্গের মতই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির ছত্রছায়ায় তা নোংরামীর একরকম চুড়ান্ত পর্যায় পৌছেছে। (১৪)

(সম্পাদক: হাবিব ওয়াহিদ / অনিন্দ্য, ১৯৮৭।।)

“লেখার বিষয় নির্বাচনে অবাধ স্বাধীনতা। প্রয়োজনে ডাইরির পাতা ছিঁড়ে পাঠিয়ে দিন। ব্যর্থ প্রেমের চিঠিও প্রকাশ করতে আমরা আগ্রহী। আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নেই। কিন্তু অনিন্দ্যের পাতায় সেই স্বাধীনতা আছে। সবাই সব ধরনের লেখা পাঠান। প্রয়োজনে আমরা বাসায় গিয়ে ভিক্ষা করে লেখা আনতে সক্ষম।
লেখকদের পিছনে ঘুরে ঘুরে, বিজ্ঞাপন কর্মাধ্যক্ষদের পায়ে গব্যঘৃত ঢেলে অবশ্য সবার পায়ে নয় উদয়াস্ত পরিশ্রম করে আমাদের দফারফা। বাবা মা’র বকুনি, পকেটের করুণ অবস্থা সব মিলিয়ে সম্পাদকীয় লেখার সময় কই?
পুনশ্চ নানাবিধ সমস্যার কথা বলে লাভ কি? লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশনা অব্যাহত না রেখে বরঞ্চ আলু পটলের ব্যবসা করা ভালো। তবু সীমিত শক্তিতে অনিন্দ্যর অগ্রযাত্রা সফলভাবে এগিয়ে যাবে, এই আত্মবিশ্বাসটুকু আছে বলেই ভরসা। ছাপার ভুল না থাকলে সেটা কোন লিটল ম্যাগাজিন না অতএব...”(১৫)

(সম্পাদক: তপন বড়ুয়া, গান্ডীব, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।।)

“প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগে প্রমিতির নামে এই ‘মিষ্টি’  করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো—  প্রাদেশিকতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে ভাষাকে একটা সর্বজনীন রূপ দেয়ার জন্য।  সে সুযোগে ছড়ি হাতে জেঁকে বসেছিলো নগরের এলিটিজম। ভাষা মিষ্টি হতে হতে সর্বাঙ্গে ছড়ালো তার মরণঘাতী মধুমেহের বিষ। সময়ের স্রোতে এখন বাতাসে ভাসে তার লাশের গন্ধ। সাহিত্যভাষায়ও  ‘ছন্দোবন্ধনে অধরা মাধুরী’র  আকাশ ধরতে গিয়ে পা হারালো মাটির সংলগ্নতা। আরেকদিকে নতুন সহস্রাব্দে গজিয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা নিয়ে মিডিয়া বাণিজ্য। ছ্যানেলের বাংলা সংবাদবালিকারা অবশ্য নাকী সুরে ঘুচিয়ে দিলো পূর্ব-পশ্চিমের ফারাক! কিন্তু মিডিয়ার হাতে ভাষা হয়ে উঠলো একই সঙ্গে যোগাযোগ বাণিজ্যর পুঁজি এবং দুঃশাসনের শস্ত্র।  একটাই লক্ষ্য স্বীয় ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান যা চায়।  নিজেদের সংশ্লেষণ-বিশ্লেষণের কারখানায় তৈরি করতে শুরু করলো এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষা। ওদের পাচকরা আবার মার্কিনী টোলের পন্ডিত।  বেত্রদন্ড হাতে অমোঘ ফতোয়া ছোড়ে— ‘চাই পূর্বদেশের বিশেষ ভাষা, কিন্তু শব্দরাজি ধরতে হবে মধ্যদেশের।’
অত্যাধুনিক কালে সৃষ্টিশীল ভাষার চেহারা পাল্টে যাচ্ছে পশ্চিমী তত্ত্বের চাপে যত না তার চাইতে বেশি অকারণ জোর খাটানোর কারণে। এর নানা বয়ান, নানা ধরন! আমরা চাই না মাটি ছেড়ে কেবল আকাশে উড়ি কিংবা অকারণে মাটিতে গড়াগড়ি খাই। চাই মাটি আর আকাশের মধ্যে রঙধনুর বন্ধন ঘটুক, একটু যাওয়া-আসার পথ থাকুক।
অত্যাধুনিক কালে সৃষ্টিশীল ভাষার চেহারা পাল্টে যাচ্ছে পশ্চিমী তত্ত্বের চাপে যত না তার চাইতে বেশি অকারণ জোর খাটানোর কারণে। এর নানা বয়ান, নানা ধরন! আমরা চাই না মাটি ছেড়ে কেবল আকাশে উড়ি কিংবা অকারণে মাটিতে গড়াগড়ি খাই। চাই মাটি আর আকাশের মধ্যে রঙধনুর বন্ধন ঘটুক, একটু যাওয়া-আসার পথ থাকুক।
যারা আমাদের সঙ্গে এসেই চলে গেলেন— একটি বাতি জ্বালাই তাদের পথে। চিহ্নিত শত্রুর ঘৃণ্য, তার চাইতেও বেশি ঘৃণ্য ছদ্মবেশী শত্রু।  ও’রা চাকু চালায় গোপনে, অন্ধকারেরকাপুরূষের মতো। নতুন যারা এলেন, তাদের জানাই শুভেচ্ছা।
শুভার্থীদের সবাইকে শুভেচ্ছা।”

আমার পশ্চীমবঙ্গের বন্ধু কবি সব্যসাচী সেন, সম্পাদক , কারুবাসনা এর নিকট পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন লিটিলম্যাগ ও বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অধিকাংশ লিটিলম্যাগ সতীপনায় ব্য¯ত । অধিকাংশই আনন্দবাজার গোষ্ঠির দেশ নামক পত্রিকার অন্ধ অনুকরণে রত। এখানে লিটিলম্যাগাজিনের কোনো আন্দোলনই নেই । যে মানুষ পরাজিত হয়ে বেঁচে থাকতে চাইবে সে ঘরে বাইরে আক্রান্ত হবেই। এটাই তার নিয়তি।
বাজারি পণ্য সাহিত্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, লেখকদের সৃজনশীলতা, চৈতন্যের বিকাশ, নতুন কিছুর পরীক্ষা-নীরক্ষিা প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করছে। লেখক সত্তার নিজস্ব চীন্তাচেতনার  অনুভুতিকে প্রতিবন্ধি করে রেখেছে।

অপরদিকে,“ লিটল ম্যাগজিন থেকে আরো বেশি চাই-চাই এ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট মানসিকতা। প্রচ- রাগী চেহারা হবে তার। কোনরকম কম্প্রোমাইজের মধ্যে নেই সে। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে তার বিতৃষ্ণা হবে আন্তরিক, ব্যবসায়িক স্বার্থে যে সব আধমরা লেখককে প্রতিষ্ঠান তুলে ধরতে চায়, দেখাতে চায় এরাই লেখক, এদের লেখাই বাজারের সেরা মাল-তাদের, সেইসব যশ-কাঙালের মুখোশ খুলে দেয়ার দায়িত্বও লিটল ম্যাগাজিনের। প্রচলিত দৈনিক সাপ্তাহিকগুলোতে সাহিত্যের নামে মাকাল ফল যে রগরগে ঝালচচ্চরি চালাবার চেষ্টা করা হয়, তা স্বাদু হতে পারে কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে তা মারাত্মক, সেখান থেকে কলেরা ছড়াবার সম্ভাবনা প্রবল। এ সম্বন্ধে পাঠককে সতর্ক করে দেবার দাযিত্বও লিটল ম্যাগাজিনের।

৪.
সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো সময়ের বাস্তবতা,  সবাই ভুল শিক্ষা দিলেও বাস্তবতা কখনো ভুল শিক্ষা দেয় না। এদেশে অনেকেই আছে এখন নিজেকে লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট এর প্রথারবিরোধীতা তথা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার চর্চার সাথে জড়িত রাখেন । তারা মনে করেন ছোটকাগজ এর সাথে নিজের নাম লতায়-পাতায় জড়িয়ে থাকলে সমাজে  খুব বেশি স্মার্ট ভাবে পরিচিতি পাবেন। তারা মনে মনে ধরে রাখে তারা সবকিছুই জানে। তারা সবকিছুই পারে। কিন্তু যখন বাস্তবে ফিরে আসে তখন দেখা যায় তারা আসলে কিছুই জানে না, কিছুই পারে না,  কখনো কখনো এরা নিজেকে খুব বেশি স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে কখন যে হাসির পাত্র হয়ে যায় তা টেরই পায় না, বুঝতেই পারে না !!" ছোটকাগজ এর সাথে নিজেকে যুক্তরাখা কে এক রকম ফ্যাশান মনে করেন। অত:পর সুযোগ বুঝেই লেজ গুটিয়ে কেটে পড়েন অথবা বের কাে দেয়া হয় কারন অচিরেই তাদের মুখোশ খুলে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে।

মোট কথা, অন্যভাবে বললে আমাদের সমাজের কাঠামোগত দিক, সংস্কৃতির জগতেও চারিয়ে আছে সেই একই লড়াই। যে কাগজের পুঁজি তিনশ টাকা আর যে কাগজের তিরিশ লক্ষ তাদের উদ্দেশ্য কখনও এক হতে পারে না। সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যবসায়িক কাগজের সঙ্গে নিজের নাম জড়ানোকে এক ধরণের বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া অন্যকিছু মনে করি না। সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলি তো আমাদের দেশে , কুকুর পোষার মতো লেখক পোষে। আবার যাঁরা বই ছাপার জন্য রাইটার্স বিল্ডিং থেকে আথবা বাংলাবাজার থেকে শাহবাগ  মুদ্রার শব্দ আনতে যান তাঁরাও ব্যবহৃত হন প্রায় একই রকমভাবে। প্রত্যক্ষভাবে হয়তো নয়, কিন্তু পরোক্ষে তাঁদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিছু না কিছু কেড়ে নেওয়া হয়ই। নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে তাদের ব্যবহার করা হয় এবং ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়- এ ।

বিগত একদশকে বাংলা কবিতায় এসে গেছেন বেশ কিছু নতুন স্বল্প পুঁজি-হাতে নিয়ে এগিয়ে চলা লড়াকু প্রকাশক, যারা, সযতেœ এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিদের বই ছাপছেন, য়েমনঃ উলুখড়, প্রতিশিল্প, করাতকল অন্যতম একটা বিকল্প পাঠকবৃত্ত অলরেডি তৈরি করে ফেলেছেন তারা, বাল-বাজারি পাবলিশারের চেয়ে তাদের ছাপা কবিতার বইয়ের বিক্রি নিঃসন্দেহে বেশি, এসে গেছে ফেসবুকের মতো অসম্ভব শক্তিশালী কবিতা-মাধ্যম যেখানে একদম সরাসরি লেখক-পাঠকের ইন্টার-অ্যাকশন ঘটছে, বাল-বাজারি মনোপলি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে আর এক দশকের মধ্যেই, হতে বাধ্য, মার্কেটের নিজস্ব লজিকেই তা ঘটবে, ঘটবেই কমরেড, ঘাবড়াবেন না, পিছু হটবেন না, লড়াই জারি রাখুন!!

“প্রসঙ্গ লিটলম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং সুবিমল মিশ্র: মারুফুল আলম (‘দ্রষ্টব্য’ সুবিমল মিশ্র সংখ্যা, ১৯৯৮) শীর্ষক গদ্য গ্রন্থে পুরো বিষয়টি পরিস্কার করে দিয়েছেন:-

ক. প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান।
খ. সংবাদ সাহিত্যের ফ্যাক্টরিগুলো বাজারী লেখক পয়দা করছে।
গ. প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুনাফা লোটা আর সে কারণে যেভাবেই হোক না কেন এমনকি নিছক মনোরঞ্জনের মাধ্যমে হলেও ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠী করায়ত্তপূর্বক তাদেরকে শিল্প-সচেতন না করা।
ঘ. রেডিও-টিভি এবং নানাবিধ মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের সাহায্যে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা।
ঙ. সিরিয়াস পাঠককে ইন্টেলেকচুয়্যাল বলে বসিয়ে দেয়া।
চ. তরুণ লেখক গোষ্ঠী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের সম্পূর্ণ বড়বাজারীয় পদ্ধতি অবলম্বনপূর্বক প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া পোষ্য লেখকদের রীতিমাফিক মরা ইঁদুরের মত ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা।
ছ. সিরিয়াস আপোষহীন লেখকগণকে চরম ও নগ্নভাবে আক্রমণ করা।”(১৬)

সাহিত্যের জন্য কোন যুদ্ধ নেই, সেখানে শহীদ নেই। গ্রেট লেখক অনুপ্রাণিত জায়গা থেকে আসে, ব্যবসা এমন একটি স্থান যেখানে সাহিত্য হয়না। তাহলে আপনি কী করবেন?? অভিমান আর অপমান সহ্য করে দূরে সরে যাবেন?? সার্কিট থেকে বেরিয়ে যাবেন??? অস্ত্র সমর্পণ চুক্তি করবেন???


৫.
এলিট ম্যাগাজিনগুলি, প্রায়ই "ছোট কাগজ" নামে পরিচিত, সাহিত্যিক পত্রিকাগুলি যা তুলনামূলকভাবে অজানা লেখকদের পরীক্ষামূলক ও অ-কনফিউমথিত রচনাগুলি প্রকাশ করে। তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাধারণত অবাণিজ্যিক। সর্বাধিক উল্ল্যেখযোগ্য উদাহরণ হল ছোট কাগজ ধারণাটি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এসেছে পাশ্চাত্য থেকে; মোটের ওপর গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে (১৯১২) হ্যারিয়েট মনরে সম্পাদিত যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত পোয়েট্রি: আ ম্যাগাজিন অব ভার্সকে উপলক্ষ করে। তবে তারও আগে যুক্তরাষ্ট্রেরই বোস্টন শহর থেকে প্রকাশিত প্রচলিত ধর্মবোধের বিরুদ্ধে কথা বলা অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক পত্রিকা দ্য ডায়াল (১৮৪০-৪৪) কিংবা ভিক্টোরীয়-বস্তুবাদবিরোধী ইংরেজি পত্রিকা স্যাভয়কে (১৮৯৬) বলা যেতে পারে এই ধারণার আদি রূপ। পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে একে একে প্রকাশিত হতে থাকে প্রকৃত ছোট কাগজগুলো। কয়েকটির নাম করা যেতে পারে—নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আদার্স (১৯১৫-১৯১৯), শিকাগো, সানফ্রান্সিসকো, নিউইয়র্ক ও পারি থেকে একযোগে প্রকাশিত দ্য লিটল রিভিউ (১৯১৪-১৯২৯), লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য ইগোয়িস্ট (১৯১৪)। এগুলো মূলত ছিল চিত্রকল্পবাদতত্ত্বপন্থীদের চারণক্ষেত্র। ১৯২০ সালে দ্য ডায়াল পুনর্জীবিত হয়ে এই ধারায় নতুনভাবে যোগ দেয়!  তাঁরাই সর্ব প্রথম লিটিলশ্যাগাজিন শব্দটি ব্যবহার করেছিল। ১৮৮০ সালে ফ্রান্সে প্রতিকীবাদী আর আমেরিকায় রুপকবাদী সাহিত্য হিসাবে এবং ১৯২০ সালে জার্মানীতে ব্যাপকহারে বুঁর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদীরা নানান মোড়কে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে সুভিধাবাদী বাজারি, অর্থলোভী, প্রচারমুখি, স্বঘেষিত আঁতেল শ্রেনীর বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট শুরু হয়।(১৭)
লিটল ম্যাগাজিন আধুনিকতা ঘটতে পারে। এই আধুনিকতার বিকাশে সামান্য ম্যাগাজিনের অবিচ্ছেদ্য ভূমিকার পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দেয় লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট।

এই ধরনের রূপান্তরগুলি অধ্যয়নরত সময়ে, প্রাকৃতিক অর্থনীতির নির্ভুলতা, এবং আইনী, রাজনৈতিক, ধর্মীযয়, শৈল্পিক বা দার্শনিক - সংক্ষেপে, মতাদর্শগত আকারে নির্ধারণ করা যেতে পারে যা উৎপাদন অর্থনৈতিক অবস্থার উপাদান রূপান্তর মধ্যে পার্থক্য প্রযয়োজন সবসমযয়। যা এই দ্বন্দ সচেতন এবং এটি যুদ্ধ আউট। যেহেতু একজন নিজের সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যক্ত করে তার বিচার করেন না, তাই তার চেতনা দ্বারা রূপান্তরের এই সময়ের বিচার করা যায় না, বরং বিপরীতভাবে, এই চেতনা বস্তুগত জীবনের অসঙ্গতি থেকে ব্যাখ্যা করা উচিত, বিদ্যমান সংঘাত থেকে উৎপাদনের সামাজিক শক্তিসমূহ এবং উৎপাদন সর্ম্পকের মধ্যে পুরানো সমাজের কাঠামোর মধ্যে পরিপক্বতা অর্জনের আগে যে সব উৎপাদনশীল শক্তির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত করা হয়েছে তার আগে কোনও সামাজিক ক্রম ধ্বংস করা হয় না এবং উৎপাদনের নতুন উচ্চতর সম্পর্কগুলি পুরোনো লোকদের পরিবর্তে পুরানো অবস্থার পরিবর্তে তাদের অস্তিত্বের উপাদানগুলির আগে স্থির হয় না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি প্যাসিভ পণ্য হিসাবে শিল্প যোগ্যতা অর্জন করতে কোন প্রকারে ছিল। বিপরীতভাবে, তারা জোর দিয়েছিলেন যে সামাজিক সচেতনতার বিভিন্ন রূপ - অবশ্যই, শৈল্পিক সৃষ্টি সহ - সামাজিক বাস্তবতা যা তারা উত্থানকে সক্রিয়ভাবে প্রভাবিত করে। শৈল্পিক সৃষ্টির সমস্যায় সমাজতান্ত্রিক অসঙ্গতি বজায় রাখার জন্য মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন যে সামাজিক জীবন এবং বিশেষ শ্রেণীর মতাদর্শ শিল্প থেকে দূরে একটি যন্ত্রবিন্যাস পদ্ধতিতে প্রতিফলিত হয়। শিল্পসম্মত সৃজনশীলতা সামাজিক উন্নয়নের সাধারণ আইনগুলির অধীনস্থ হয় কিন্তু, চেতনা একটি বিশেষ ফর্ম হচ্ছে, এর নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং নির্দিষ্ট নিদর্শন রয়েছে। শিল্পের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে এটি একটি আপেক্ষিক স্বাধীনতা যা বিকশিত হয়। শিল্পকর্মটি ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর সাথে যুক্ত থাকে এমন নয় যে এই সামাজিক কাঠামোগুলি অদৃশ্য হয়ে গেলে তারা তাদের তাৎপর্য হারায়।

অস্তিত্বের সামাজিক প্রযোজনার মধ্যে, নারী-পুরুষ নিঃসন্দেহে নির্দিষ্ট সম্পর্কগুলির মধ্যে প্রবেশ করে, যা তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা, উৎপাদনের বস্তুনিষ্ঠ শক্তির বিকাশে প্রদত্ত পর্যাযয়ে যথাযথ উৎপাদন সম্পর্কিত সম্পর্ক। উৎপাদনের এই সম্পর্কগুলির সামগ্রিকতা সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করে, বাস্তসব ভিত্তি, যা একটি আইনী ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা সৃষ্টি করে এবং সামাজিক সচেতনতার নির্দিষ্ট রূপগুলির সাথে সম্পর্কিত। বস্তুগত জীবনযাপনের উৎপাদন পদ্ধতি সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সাধারণ প্রক্রিযয়া। এটা মানুষের চেতনা নয় যে তাদের অস্তিত্ব নির্ধারণ করে, কিন্তু তাদের সচেতনতা নির্ধারণ করে তাদের সামাজিক অস্তিত্ব। উন্নয়নের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে, সমাজের বস্তুগত উৎপাাদনশীল শক্তির উৎপাদনের বিদ্যমান সর্ম্পকের সাথে দ্বন্দ সংঘটিত হয় - এগুলি কেবল আইনসম্মতভাবেই একই জিনিস প্রকাশ করে - যার ফলে তারা যে কাঠামোর মধ্যে সম্পত্তির সম্পর্ক স্থাপন করেছে তা এখন পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে। উৎপাদনশীল শক্তির বিকাশের ধরন থেকে, এই সম্পর্কগুলি তাদের শরীরে পরিণত হয়। তারপর সামাজিক বিপ্লবের একটি যুগ শুরু হয়। অর্থনৈতিক ফাউন্ডেশনের পরিবর্তনগুলি আজকে বা পরে সম্পূর্ণ অপরিমেয় ঘূর্ণিঝডড়ের রূপান্তরের দিকে পরিচালিত করে।

 “এইভাবে অনিশ্চিতভাবেই এমন কিছু কাজ করে যা সেটিকে সমাধান করতে সক্ষম হয়, যেহেতু ঘন ঘন পরীক্ষা সবসময় দেখায় যে সমস্যাটি কেবল তখনই উত্থাপিত হবে যখন তার সমাধানের জন্য বস্তু গত শর্তগুলি ইতোমধ্যে উপস্থিত বা অন্তত গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে। বিস্তৃত সীমারেখা, এশিয়াটিক, প্রাচীন, সামন্তবাদী ও আধুনিক বুর্জোয়া মোডের উৎপাদন সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুগোপযোগী অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। উৎ্পাদনের বুর্জোয়া মোড হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিযয়ার শেষ প্রাস্তিক রূপ - ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুভূতিতে নয় কিন্তু একটি বিরোধের যে কোন ব্যক্তির অস্তিত্বের সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করে - কিন্তু বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে উৎপাদনশীল শক্তি সৃষ্টিকারী বাহিনীও তৈরি করে। উৎপাদান শর্তাবলীএই বিরোধিতা একটি সমাধান জন্য। মানব সমাজের প্রাগৈতিহাসিকভাবে এই সামাজিক গঠন বন্ধ করে দেয়”
- কার্ল মার্কস”।(১৮)

'নৃতাত্ত্বিকতার' মতাদর্শের ধারণা, শিল্পের জন্য শিল্পের ধারণার একটি বিশ্বাস, অবনমনটিও প্রকৃতিবাদ বিরোধী প্রতিক্রিয়া ছিল। সাহিত্যিক ইতিহাসে, শব্দটি হ্রাস বিশেষভাবে প্রযোজ্য নৈতিকতা অনুভূতি, কামুক বা বহিরাগত চিত্রাবলী, এবং নন্দনতত্ত্ব দ্বারা চিহ্নিত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রযোজ্য হয়েছে।"ছোট কাগজ", এই একই ধারনা অনুসরণ করে, উচ্চ এবং নিম্নতর শিল্পের মধ্যকার সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে, কঠোর জিনগত পার্থক্যকে প্রত্যাখ্যান করে, পেস্টিস, প্যারোডি, ব্রিকোলজ, পলাশ এবং খেলাধুলার উপর জোর দেয়, স্ব-চেতনা, বিভাজন এবং বিচ্ছিন্নতা (বিশেষত আখ্যান কাঠামোর মধ্যে), অযৌক্তিকতা, একযোগে, এবং ধ্বংসাত্মক, সমৃদ্ধ, অমানবিক বিষয় উপর একটি জোর সমর্থন করে।যেহেতু আধুনিকতা সর্বদা ক্রমান্বয়ে ক্রমান্বয়ে ক্রমহ্রাসের দিকে চলে, তাই আধুনিক সমাজগুলি ক্রমাগত কিছু এবং "ডিসঅর্ডার" হিসাবে লেবেলযুক্ত সবকিছুকে সতর্ক করে দেয় যাতে অর্ডার ব্যাহত হয়। এইভাবে আধুনিক সমাজরা "অর্ডার" এবং "ডিসর্ডার" এর মধ্যে একটি বাইনারি বিরোধী প্রতিষ্ঠা করে, যাতে তারা "অর্ডার" এর শ্রেষ্ঠত্বকে দাবি করতে পারে। কিন্তু এটি করার জন্য, তাদের "ডিসঅর্ডার" এর প্রতিনিধিত্ব করে এমন জিনিস থাকতে হবে - আধুনিক সমাজ এইভাবে ক্রমাগত "ডিসঅর্ডার" তৈরি / তৈরি করতে হবে। আরো পরিস্কার ভাবে এই ভাবনা বোঝার জন্য মার্কসবাদের "মহৎ আখ্যান" ধারণাটি পরিস্কারহওয়া দরকার "মহৎ আখ্যান" ধারণাটি হল পুঁজিবাদ নিজেই পতিত হবে এবং একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের উদ্ভব হবে। আপনি একটি ধরনের মেটা-তত্ত্ব বা মেটা-মতাদর্শ, মত, মহান কাহিনী মনে করতে পারেন, অর্থাৎ, একটি মতাদর্শ যা মার্কসবাদের সাথে ব্যাখ্যা করে। একটি গল্প যা বিশ্বাস সিস্টেমগুলি ব্যাখ্যা করার জন্য বলা হয়। লয়েড যুক্তি দেন যে আধুনিক সমাজের সমস্ত দিক, বিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান হিসাবে বিবেচ্য, এই মহৎ আখ্যানগুলির উপর নির্ভর করে। তারপর পোস্টমোডেরনিজটি ব্যাপক বিবৃতির সমালোচনা, সচেতন যে এই ধরনের বর্ণনাগুলি কোন সামাজিক সংগঠন বা অনুশীলনের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ এবং অস্থিরতা প্রকাশ করতে সহায়তা করে। অন্য কথায়, "অর্ডার" তৈরির প্রতিটি প্রচেষ্টা সবসময় সমান পরিমাণ "ডিসঅর্ডার" তৈরির দাবি করে, কিন্তু "বিদ্বেষপূর্ণ" মাস্কগুলি এই বিভাগগুলির গঠনতন্ত্র ব্যাখ্যা করে ব্যাখ্যা করে যে "ব্যাধি" আসলেই বিশৃঙ্খল ও খারাপ, এবং এটি "অর্ডার" সত্যিই যুক্তিযুক্ত এবং ভাল। "ছোট কাগজ", মহান আখ্যান প্রত্যাখ্যান করে, "ক্ষুদ্র আখ্যান," ছোটো প্রথাগুলি, স্থানীয় পর্যায়ে, সর্বজনীন বা বৈশ্বিক ধারণাগুলির পরিবর্তে স্থানীয় ঘটনাগুলি ব্যাখ্যা করে এমন গল্পগুলি সমর্থন করে।


সমাজের বৈষম্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় যা দ্বন্দ সৃষ্টি করে, এর পরিবর্তে যা আদেশ ও ঐক্যমত্য তৈরি করে। বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে এই দ্বন্দটি কেবল সমাজের বিদ্যমান সর্ম্পকের মৌলিক রূপান্তর, এবং নতুন সামাজিক সম্প্রদায় এর জন্য ফলদায়ক হয়ে উঠতে পারে। অসুবিধার এমন কাঠামোগত স্বার্থ রয়েছে যা স্থিতিবিন্যাসের প্রতি পাল্টা চালায়, যা একবার অনুমান করা হলে তা সামাজিক পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত হবে। সুতরাং, বস্তুগুলির পরিবর্তে তাদের পরিবর্তে এজেন্ট হিসাবে দেখা হয়, যাতে একজনকে সহানুভূতি হওয়া উচিত। আজ লিটিল ম্যাগাজিনের, লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রয়োজনীতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আর তাই নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে উঠে আসা কোনো লেখক গোষ্ঠী আমরা পাচ্ছি না আমার ব্যতিক্রমী মনে হচ্ছে এবং মনে হচ্ছে এই অবক্ষয়ের যুগে যদি এদের হাত ধরে কিছু একটা পরিবর্তন আবার আসে। এখন সম্ভবত ঐ একটি কাগজেই আমরা তরুণ প্রজন্মের একটা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রয়াস দেখতে পাচ্ছি যাঁরা পা রেখেছেন কেবল লিটিল ম্যাগাজিনের তরণীতেই। এঁরা বিপথগামী না হন।” সাহিত্য সম্পাদক এখানে ওখানে নিজেকে মার্ক্সবাদী বলেও দাবি করেন, দাবি করেন বস্তুবাদী বলে। এই বয়ান শুধু সমস্ত বাস্তব বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় লিটিল ম্যাগাজিন নামধারী পত্রিকাগুলোকে আশ্রয় করে । খোলসা কওে বললে আমরা বুঝি সংঘর্ষ তত্ত্ব সর্বাধিক মার্কসবাদের সাথে যুক্ত, তবে কার্যকারিতা এবং ইতিবাচক পদ্ধতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্যান্য দৃষ্টিকোণগুলির সাথেও সংশ্লিষ্ট হতে পারোধিপত্যকে ধ্বংস করাই আজকের দাবি, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য!!
প্রতিষ্ঠান বিরোধী  তথা লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট  অবসম্ভাবি ভাবে নিজেকে নিজের প্রতিদ্বন্দি করে তোলে।

“এ দিকে চাষীরা মার খাচ্ছে,
অন্যদিকে উনারা দাত কেলাচ্ছে,
কবিতা পাঠ করছে,
এানুষগুলো বানচোদ না এমিবা।”!
বা
আমি একটি ইতরেরদেশে থাকি,
এখানে বণিকেরা লেখকদেও উদ্ভাবন করে,
এবং লেখকরাও উদ্ভাবিত হয়।”
(কবি নবারূণ ভট্টাচার্য)(১৯)

আজ সেই ভিন্ন স্বরকেও মেইনস্ট্রিমের ভিতর নিয়ে এসেই মূলধারাটিকে আক্রমণ করতে হবে, যা জিজেকের ভাষায়: "বিটন অ্যাট দেয়ার ওন গেম", ইউরোকেন্দ্রিক ভাষাকে আত্মস্থ’ করেই ইউরোকেন্দ্রিক আধিপত্যকে ধ্বংস করাই আজকের দাবি, নয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য!!

আশরি দশকের প্রতিষ্ঠান বিরোধি আন্দোলন বা লিটিলিম্যাগ কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বর্তমান প্রজন্ম দৃষ্টিভঙ্গি একে দেখায়, জড়, আর্থব-পঙ্গু, চিন্তার দৈনতাই আমাদের ভাবিত করে এবং ভাবিত হই, উত্তর-উপনেকেশিককালে, আমাদের সহিত্যেও ঔপনেবেশিক প্রেতের অস্তিত্ব বিরোধিতা অনিবার্য কাম্য।মেরুদন্ডহীন ফরমায়েশী চিন্তায় মধ্যবিত্ত সমাজের সব শেনীর মধ্য এখন হয়নি সুষম পূর্ণাঙ্গতা। চিন্তার অসংলগ্নতা, ঔপনেবেশিক, পরে বুঁর্জোয়া শ্রেনীর প্রতি নতজানু প্রভুর শেখানো আদব লেহাজ অজান্তেই মগজে তাদের ক্রীয়শিীল। জিরো জেনারেশনেও প্রভুদের বড় কওে দেখার বাতিক তাক করে ফেরে আজও, সেজন্য ঘটে যায় সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। তন্ত্রীতে, ¯œায়ুতে, মগজে, শীরায়-শীরায় ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য এর একমাত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রথা ভেঙে ফেলা। মানুষকে সচেতন ভাবে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করছে,একা, নিঃসঙ্গ, চিন্তান্তুন্য, একরৈখিক, ছোটকাগজের পাঠক কম, কিন্তু সামান্য ম্যাগাজিনটি তার তিক্ততা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে, তার লক্ষ্য দ্বারা নয়,সম্পাদক বা প্রকাশকের বড় পুঁজীর শক্তি নেই। কিন্তু তার একটি বড় স্বপ্ন আছে। একটি অস্তিত্ববাদী স্বপ্ন একটি নির্মিত টার্ন আছে; লক্ষ্য এবং প্রকাশ করা যেতে পারে যে সামান্য পরিমাণ শব্দ "সামান্য" ফরসরহরঃরাব কিন্তু অন্যান্য জিনিস আছে; এটি শুধু একটি ধারক নয়, এটি লেখকদের একটি ছোট বৃত্ত, একটি একীভূত অঞ্চল, কি ধরনের সাহিত্য তারা জন্য নিশানা করছি এটা তাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠে সমাজ, রাজনীতি,সংস্কৃতি সচেতনতাহীন ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দিচ্ছে তার মনন, এটা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি একদিনে নয় আশির আগে থেকে। লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট  অস্তিত্বের এই জায়গাটি বাধা দিতে পরে এখনই,এই মুহূর্ত থেকেই । লিটিলম্যাগ সাহিত্যে গতিশীলতার বেলাগাম সৃজন প্রথা বিরোধীদের দাড়াবার জায়গা।

‘সমাজরে প্রশ্ন থাকলে দায়রে বোধও থাকবে। কোথায়? যখোনে দায়বোধটা প্রত্যকেরে মধ্যে একইরকমভাবে ক্রিয়া করবে, সেখানইে তো; কোন সে সমাজ? যখোনে মানুষ যে কনিা কোনো কাজরে জন্যে কবেল এককভাবইে দায়ী। অন্তত এই সমাজে না। তার সম্পন্ন-সত্তার একক কীই-বা? এই যে প্রাইভিেস আর র্পাসোনাল নিয়ে কতো বতিক; মানুষরে সৃজনর্কমরে সময়টুকু ছাড়া আর র্বজ্য-পরহিাররে সময়টুকু ছাড়া, তার প্রাইভসেরি কতটুকুই-বা প্রয়োজন?”

আর যারা সচেতন,তাহাদের বলিঃআসুন,আমরা অন্যকেও সচেতন করতে সচেষ্ট হই।স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধে খুলে ফেলি তাদের মুখোশ।হ্যাঁ,এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আর স্বাভাবিক প্রতিবাদ ছাড়া তাদের কৃতকর্ম ছুড়ে ফেলি সেফটি ট্যাংকে, আমরা আর কিইবা করতে পারি?

৬.

মূলত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও, মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন। কালের দিক থেকে আধুনিক যুগকে কয়েক টি ধাপে ভাগ করা হয়েছে- ১৭৬০-১৭৯৯খ্রিঃ(আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব) ১৮০০-১৮৫৮খ্রিঃ(আধুনিক যুগের দ্বিতীয় পর্ব) ১৮৫৯-১৯০০খ্রিঃ(আধুনিক যুগের তৃতীয় পর্ব) ১৯০১-১৯৪৭খ্রিঃ(আধুনিক যুগের চতুর্থ পর্ব) ১৯৪৮-২০০০খ্রিঃ(আধুনিক যুগের পঞ্চম পর্ব) ২০০১খ্রিঃ- বর্তমানকাল(আধুনিক যুগের ষষ্ঠ পর্ব)।
বর্তমানকাল(আধুনিক যুগের ষষ্ঠ পর্ব)।আর্থাৎ আমরা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের ষষ্ঠপর্ব আর্থাৎ সর্বচ্চো আধুনিক যুগের সাহিত্যকর্মী ।(২০)

সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের তৎপরতা ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি আবিষ্কার ও তৎসহ ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সমালোচনা থাকলেও এসবের বিরুদ্ধে বিকল্প কর্মসূচি হিশেবে- প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা- আশির দশকেই এক নতুন আদর্শ ও মতবাদ নিয়ে আরেকটি ডিসকোর্স রচনা করে ছিল। এই ডিসকোর্সে প্রতিষ্ঠানের আদিকল্পকে কীভাবে নস্যাৎ করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক নানামুখী প্রয়োগ সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতাযুক্ত হয় সেই ক্ষমতা তখন নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে জন্ম নেয় স্বৈরাচারের।

আশির দশকে হঠাৎ তামাশায় অস্ত্রজ্ঞানে লড়াই করার কাস্তে যখন অস্তমিত চাঁদের মতো ক্রমে বিলীন হয়ে গেলে ঘোর অমাবশ্যা বোধিকে গ্রাস করে ফেলল এবং বিষ ফোঁড়ার মত দেশ-কাল-পাত্র যখন স্বৈরশতি তখন তার সঙ্গে সঙ্গে কারো সংগ্রাম কিংবা কারো সংগম চলতে লাগল, এসময়ে আপাত দুর্বলতা, কখনো সীমাবদ্ধতাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে শক্তি হিশেবে বিবেচনা করার আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার সূত্রে নতুন জ্যামিতিক বিন্যাস রচনা আরম্ভ করল।

আশির দশকে এই  প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা কে তাই লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট কে বহুমুখী ধারনায় এনে সেলিম মোরশেদ বলেন, “আমাদের দায়বদ্ধতা তাই অন্য সময়ের থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বেশী। আমরাই বাংলা সাহিত্যের বেগদান করবো, সকল প্রকার ইউরোপীয় ভাব ধারায় ও দুইশত বছরের অধীক শাসন-শোষন, নিপীড়ন, নির্যাতন, ঔপনৈবেশিক সা¤্রাজ্যবাদ এর যাতাকলে পীষ্ঠ হয়েছি। যেকারনে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের সৃষ্ট সাহিত্য ইউরোপীয় ভাব ধারার সাথে ঔপনৈবেশিক সা¤্রাজ্যবাদ এর আমাদেও উপর চাপিয়ে দেওয়া মধ্যবিত্তের মানসিকতার দ্বান্দিকতা দ্বীধাদ্বন্দ পাশাপাশি পাশ্চত্যে ধারকরা দার্শনিক অনুপ্রবেশের ফলে বাংলা সাহিত্যের স্বকীয় ভাব ও ভাবনার সৃজনশীল চৈতন্যের পূর্ণাঙ্গতার প্রকাশ হয়নি।তাই এখনও বাংলা সাহিত্যের নিজস্বতার রুপান্তর চলমান প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর প্রয়োজনে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের কর্মকান্ড, তাত্ত্বিকতা, আন্দোলন জানাটা জরুরী। সব মহৎ কাজের পেছনে অৎজ¯্র স্বপ্নবাজদের শ্রম, মেধা, দর্শন জড়িত।”

অতএব, আসুন, আমরা আমাদের স্বপ্ন আর দ্রোহকে ধান্দাবাজ হইতে দূরে রাখিতে সম্মিলিত প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে সক্রিয় হই।


7.
আশির দশকে লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত হলো আরও একটা নতুন মাত্রা। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের কবিতা গল্প উপন্যাস একটা জায়গায় পৌছে রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে ভাবছিলেন কোনো কোনো তরুণ। তাদেরই উদ্যোগে নতুন ভাবনার বাহক হিসেবে প্রকাশিত হলো বেশ কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিন। নতুন ধরনের কবিতা ও গল্পের সুবাদে এই পত্রিকাগুলোর শীর্ষে অবস্থান করে নিয়েছিল গাণ্ডীব। একবিংশের মধ্যেও এরই বিচ্ছুরণ দেখা গেছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় উত্তরাধুনিক ভাবনার লিরিক। ঢাকা থেকে লেখক শিবিরের তৃণমূল পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আবদুল মান্নান সৈয়দ শিল্পতরু সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন। রাজশাহী থেকে এইসময়ে প্রকাশিত হয় আরও একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা পেঁচা আর ঢাকা থেকে প্রান্ত। স্বল্পায়ু মনন ঋদ্ধ এসব পত্রিকার মধ্য দিয়েই নতুন ধরনের মনোগহনধর্মী আত্মগত সংহত কবিতাচর্চার সূত্রপাত ঘটে। গল্পের চর্চাও নতুন করে গতি পায়। শিল্পের সবগুলো শাখাই যে একসূত্রে বাঁধা, এমনকি দর্শন ও গণিতকেও যে অগ্রাহ্য করা যায় না, অথবা বৈশ্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা  যেমন উত্তরাধুনিকতা কিংবা দেরিদা-ফুকো-সাঈদের সমকালীন ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন, এর সবই সেই প্রথম লেখকেরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নব্বইয়ের দশকে দেখা গেল এই ভাবনাই জায়গা করে নিচ্ছে এই সময়ের কবিদের দ্বারা প্রকাশিত লিটিলম্যাগগুলোতে। কবিতা মনোগহনতার কথা বলতে গিয়ে হয়ে উঠেছে আরও বিমূর্ত, অনির্দেশ্য অনুভূত সংবেদনার স্বরলিপি বিশেষ।

বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার ব্যবসাদারী, মুনাফালোভী, লুটেরাপুঁজিবাজ, বিজ্ঞাপনখোর এবং একমাত্র মুনাফা কেন্দ্রিক যে চিন্তার চর্”া প্রচলিত ও তথাকতিথভাবে প্রসারিত, তার বিপক্ষে বা বিকল্পে একটা নতুন মানবিক সৃজনশীল সুষম পাল্টা ব্যবস্থা। যাকে লিটল ম্যাগাজিনের একনিষ্ঠ কর্মীগণ প্রচলিত পুঁজিতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উল্টা স্রোতে দাঁড়িয়ে বিকল্প একটি সুষম প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যার কোন দাসত্ব নেই, মুনাফার মনোভাব নেই, যা আছে নিজের মধ্যে বলকে উঠা সামাজিক বাস্তবতার নিখাঁদ উপলব্ধ বিবরণ। যা এ বুর্জোয়া কাঠামোকে ক্রমশ আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে চৈতন্যের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে থাকে। এখানেই আসলে মূল কথাটি অন্তর্নিহিতভাব নিয়ে জ্বলে উঠে। যদি চেতনা হয় শ্রেণীবিভক্ত সমাজ পাল্টানোর।

এ সময়ের মৌলিক সাহিত্যে ভাটা পড়েছে। গবেষণা, প্রবন্ধ, ও সমালোচনার দিকেই বেশি ঝুঁকছে সবাই। প্রতি বছর গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের যে বইগুলো বেরুচ্ছে তা খুবই সস্তা মানের। তাদের গড় আয়ু ৫-১০ বছর, বড় জোর এক প্রজন্ম পর্যন্ত। ১০০ বছর পরে এই সময়ের নেতৃত্ব দেবার মত মৌলিক সাহিত্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। বুর্জোয়া কাঠামোকে ক্রমশ আক্রমণ করার সেই খেলাই শব্দের গেরিলা যুদ্ধ।
শিল্পের সবগুলো শাখাই যে একসূত্রে বাঁধা, এমনকি দর্শন ও গণিতকেও যে অগ্রাহ্য করা যায় না, অথবা বৈশ্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা – যেমন উত্তরাধুনিকতা কিংবা দেরিদা-ফুকো-সাঈদের সমকালীন ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন, এর সবই সেই প্রথম লেখকেরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নব্বইয়ের দশকে দেখা গেল এই ভাবনাই জায়গা করে নিচ্ছে এই সময়ের কবিদের দ্বারা প্রকাশিত লিটিলম্যাগগুলোতে। কবিতা মনোগহনতার কথা বলতে গিয়ে হয়ে উঠেছে আরও বিমূর্ত, অনির্দেশ্য অনুভূত সংবেদনার স্বরলিপি বিশেষ।

লিটিল ম্যাগাজিন এই জালিয়াত শোসকরা নব্য-উপনিবেশ কায়েমের মাধ্যমে কয়েকশ বছরের পুরোনো আর্ন্তজাতিক শোষক চক্রকে এক প্রায় অনতিক্রম্য শক্তিতে পরিণত করেছে। নব্য-সাম্রাজ্যবাদে এক ছাপোষা কিন্তু শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর  উদ্ভব ঘটে যারা মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা থেকে রস সংগ্রহ করে পরগাছা হিসেবে বেঁচে থাকে। বিভিন্ন ধারার সবচেযয়ে লুটেরা শ্রেনীটি সামরিক ও বেসামরিক আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগী মধ্যবিত্ত সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুদ্ধিজীবিদের নেতৃত্বে প্রথম থেকেই সংগঠিত ও অগনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার রূপকার, ধারক ও বাহক যা এদের শ্রেণী চরিত্র টিকিয়ে রাখার জন্য চরমভাবে অপরিহার্য। এরাই কৌশলগত কারণে সর্বহারা, শ্রমজীবি ও কৃষক ইত্যাদি নিন্মবর্গীয় শ্রেণী থেকে নির্বাচিত দালালদের অর্থনৈতিক শ্রেনী-উত্তোরণ ঘটানোর মাধ্যমে নিন্মবর্গীয় মানুষের উপর একছত্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক শৃঙ্খল তৈরির মাধ্যমে এক অসম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বহমান রেখেছে। এ শৃঙ্খলে গরিবের হাত-পা সব সবই বাঁধা তাই ভোটের রাজনীতিতে সবসময়ই এদেশের  লুটেরা অংশই জয়ী হযয়েছে। এক নব্য জমিদারী প্রথায় প্রজারা সব সময়ই মেনে নিয়েছে প্রভু ও তাদের পালিত দালালদের প্রতারনা ও জালিয়াতি। উপনিবেশিক আমল থেকেই এরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করলেও ক্রমে এরা নব্য উপনিবেশিক আমলে চরম পুঁজিবাদের বিকাশে মূখ্য সহায়ক অঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয় কেননা এলিটদের পরগাছা হিসেবে এরা শাষক শ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য অংশ নিজেদেরকে দেখার মানসিকতা লাভ করে যা এদের দালাল চরিত্রকে আড়াল করে দেয় আমলা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, ব্যবসায়ী, ইত্যাদি উপাধি নিজ নিজ সুবিধানুযায়ী নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয়ার মাধ্যমে। লিটিলম্যাগ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ওঠে নিজের ভাষায়। বড় বড় সাম্রাজ্যের উপনিবেশিক শাষন ও প্রতিনিধিত্ব তাদের এদেশীয় দালালদের হাতে  হস্তান্তরের মাধ্যমে যে নব্য-উপনিবেশ কায়েম করেছে তা যে কম পুঁজিতে বেশী লাভজনক ব্যবসা সে অনুসিদ্ধান্ত যে সত্য তা উপলব্ধির পর সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের এদেশীয় দালালদের উপর আর্শিবাদের হস্তকে চিরস্থায়ীভাবে প্রসারিত করে।

লিটিল ম্যাগাজিনের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ভেতর থেকেও সচেতন কবি ও গল্পকারকে নিজের সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে আলাদা করে পাঠকের অনুভবে উজ্জ্বল করে তুলতে হয়। যুথবদ্ধ থেকেও তাকে নিজেরই মুদ্রাদোষে বিশিষ্ট কোনো কবি বা লেখক হয়ে উঠবার সাধনায় ব্যাপৃত থাকতে হয়।

লিটিলম্যাগ মানেই নতুন দ্রোহী প্রতিষ্ঠান বিরোধী নিরীক্ষাপ্রবণ প্রতিভাবান নতুন লেখকের আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ ঘটবে তাতে। তাদের ভঙ্গিটিও থাকবে আক্রমণাত্মক, প্রচলিত রীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চাইবেন। একধরনের অহং ও প্রচ- দ্রোহই হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিনের লেখকদের বৈশিষ্ট্য। তবে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই লেখকদের রচনার দ্বারাই প্রভাবিত হবে সমকালীন সাহিত্য। তারাই গড়ে তুলবেন নতুন সাহিত্যরীতি Ñ ভাবনা ও শৈলী উভয় দিক থেকেই। শক্তিশালী লেখকের রচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যত গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করাই হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশের সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা।
নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দ্রোহ, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্য দিয়ে প্রতিভাবান লেখক যেভাবে উঠে আসে, সেই ভূমিকা কোনো লিটিল ম্যাগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। এত কিছুর পরও প্রকাশিত লিটিল ম্যাগগুলি দৈনিক পত্রিকার উপর তরুণ লেখকদের যে নির্ভরতা ছিল তা থেকে আমাদের সরিয়ে আনতে পেরেছে। লিটিল ম্যাগ আর ওয়েব ম্যাগগুলি নতুন নতুন লেখকের সাহিত্যচর্চার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে ।
যেহেতু সে সমস্ত ক্ষমতা কাঠামোটাকেই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আবরুদ্ধ রাখতে চায় এবং রেখেছে। সে তার মতন করেই, মানে তার চিন্তাা প্রক্রিয়া, তার ব্যবসার কায়দা, তার মহানুভবতা (অমানবিকতা)কে সে শিল্প-সাহিত্যের মধ্য দিয়েও সমাজের ভেতর তার সম্প্রসারণশীল চরিত্রটাকে সুনিশ্চিত রাখার সকল কলায় মশগুল থাকে সর্বদাই। পুঁজিবাদ এটা ভালো করেই জানে মানুষের মনস্তত্ত্বকে নিজের করায়াত্তে রাখতে হলে তাকে তার যে মানসিক খোরাক বা মানসিক উৎপাদনের কাছে যেতে হয়, সেখানটাতেও তার মতন করে একটা ক্ষমতা বলয় তৈরী কেরে রাখতে হয়। নচেৎ সৃজনশীল নিপীড়িত মানুষের একত্রিত ও সম্মিলিত হওয়ার যে সহজাত প্রবণতা রয়েছে, সে ব্যাপারে সে বেশ ভালই খোঁজ রাখে। তাই কিভাবে ভাষাকেও নিজের ‘রক্ষিতা’ করে রাখা যায় সেটা সাহিত্যপুঁজিওয়ালারা ভালো ভাবেই রপ্ত করেছে। এই চিন্তার লোকের লুটেরাদের বিরুদ্ধেও গড়ে উঠেছে নানা রকম বিরুদ্ধতার দেয়াল। পুঁজিতান্ত্রিক ভাষার বিরুদ্ধে সৃজনশীল সাম্য ভাবনার মুক্ত ভাষার লড়াই। আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে মানবিক চেতনার লড়াই। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সামাজিক নানান বাস্তবতা ও মননের যে দ্বান্দিক সংগ্রাম ও সংশ্লেষণ তৈরী হয়, তা একজন কবি বা কথা সাহিত্যিক বা সহিত্যের ও শিল্পের অন্যান্য শাখার চেতনায় সংক্রমিত হয়। এ সংক্রমণের বিষক্রিয়ায় যে বাস্তবানুগ পরিস্থিতির নিরিখে উপলব্ধি ও অনুভবের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তার চেতনার উৎপাদনটি ঘটান, সেটা কোন শ্রেণীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এটাই লেখার মূল স্রোত, যেখানে এই মুহূর্তে আমাদের সাথে বিষয়ের আলাপ শুরু হবে।
বর্তমানে, বলতে দ্বিধা নেই, প্রগতিশীল, প্রথাবিরোধী, পুঁজিবাদের প্রতিকূলে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে- এই সব শব্দ সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে ব্যবসায়ের মস্ত হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন সাহিত্যিক হয়ে উঠছেন একটা প্রতিষ্ঠান, ফলে সাহিত্য হয়ে উঠছে একটি বিশেষ ধরনের ছাঁচে ফেলে তৈরী করা পণ্য, যেখানে নান্দনিক সৌন্দর্য বলে কিছু থাকছে না। এক্ষেত্রে পাঠকরাও দায়ী, সাহিত্যকে তারা কাঁচাবাজারের ফর্দতে ঠাঁই দিয়েছেন- তাই লিটিটিলম্যাগ মুভমেন্ট সাহিত্য এখন প্রয়োজনের। প্রয়োজনের প্রয়োজনে ‘ পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ: সেলিম মোরশেদ রচিত নিমোক্ত ইশতেহারটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রতিশিল্প / সংখ্যা ২, নভেম্বর ১৯৯৪  : পাঠকের জানার জন্য ইশতেহারটি পুরো দেওয়া হলঃ-
ইশতেহারটি (২১)
পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ
এক : ইতোমধ্যে শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী উন্নতপাঠক ও গুণী দর্শক-শ্রোতা আর সকল ক্ষেত্রের সম্মানিত শিল্পী এবং শিল্পের অনুসারীরা লিট্ল ম্যাগাজিন (ছোটোকাগজ) মুভমেন্টকে সৃজনশীলতার শক্তি হিশেবে স্বীকার করেছেন।
দুই : বাংলা ভাষায় বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার লিট্ল ম্যাগাজিনের তীব্র গতি-প্রকৃতি বহুদিন থেকে রীতিমত বাণিজ্যিক-সাহিত্য-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অব্যর্থ তীরের মতো লক্ষ্যভেদী হয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে কথিত সম্ভ্রান্ত বাবুদের হাতে তৈরি হওয়া বাণিজ্যধর্মী নানা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান— অন্যদিকে, প্রগতিবাদের লেবাস পরা এক রাজনৈতিক শক্তি আর পাশাপাশি রক্ষণশীল পশ্চাৎপদ অন্য একটি দল— এই সবগুলির বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার অগ্রগামী জনগণ দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ করে আসছে।
ঐতিহাসিকভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য-নীতি পরবর্তী নানান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে পশ্চিম বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ তিনশ বছর পার করেছে। এই-মুহূর্তে তাদের ওপর সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে মাড়োয়ারী পুঁজি। এই মাড়োয়ারী পুঁজির বিরুদ্ধে আর বাবু কালচারের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সারা ভারতের লিটল ম্যাগাজিন।
তিন : যুগে যুগে, কালে কালে, সারা পৃথিবীতে রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের প্রশ্নে আর নব্যদর্শনের লক্ষ্যে সৃজনশীল অধিকাংশ লেখকই, সারা পৃথিবীর নিজেরা কাগজ বের করে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছেন— তা হয়েছে কখনও-বা গোষ্ঠীবদ্ধ কখনও-বা একক।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার দার্শনিক এবং শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিজস্ব দর্শন আর নতুন বিষয় এবং আঙ্গিকের নিরীক্ষণ প্রয়াসে তাদের নিজস্ব মুখপত্র বের করেছেন। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতোগুলি শিল্প আন্দোলন হয়েছে তাদের আন্দোলনগুলি এগিয়েছে মুনাফাবিহীন নিজস্ব মুখপত্রের মাধ্যমে।
চার : দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শত্রু মহল যারা সংস্কৃতির সঙ্গে শাখামৃগের মতো সম্পৃক্ত হয়ে ঝুলে আছেন, না-তারা লেখক হতে পেরেছেন বা পৃষ্ঠপোষক। ফলত ক্ষতিকর হয়েছেন তারা এই কারণে যে, তাদের এই ব্যর্থতা অন্যের সৃজনশীলতা থেকে আপনকার বিস্মিত হবার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এরা প্রায়শই বলে বেড়ান এই যে, তোমাদের লিটল ম্যাগাজিন যে বের হয় সেখানে তো বিজ্ঞাপন নাও, সেটা বিক্রি করো, সেটা কি মিডিয়া না? সেটা কি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় না?
অনুধাবন করা যায়, তারা যথেষ্ট অগভীর, অনুসন্ধিৎসাবর্জিত; তারা কি জানেন না বাণিজ্য কী? তারা কি বোঝেন না পণ্যের নৈমিত্তিক উৎপাদন (বাণিজ্য আর অবাণিজ্যের-এর প্রকৃতিসমূহ। তারা নিশ্চয়ই জানতে চান না— উদ্বৃত্ত পুঁজি ও দুর্বৃত্ত পুঁজির নির্ধারিত প্রক্রিয়া। এই পুঁজিই শোষণের জন্ম দেয়। কেননা কর্মের মুনাফা তখন মূল লক্ষ্য। ছোটো কাগজ বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিট্ল ম্যাগাজিন কখনোই মুনাফালোভী মাধ্যম হিশেবে প্রকাশিত হয় না। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
পাঁচ : অবশ্যই মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ছোটো কাগজে ছাপা হবে না। জাতীয় পুঁজি (টার্মটা এক অর্থে ভুল) না বলে বরং জাতীয় আয় বলি; সেই জাতীয় আয় আমাদের বৃদ্ধি হয়েছে কম্পিউটারের সফটওয়ার আর গার্মেন্টস থেকে। আমরা প্রতিটা কম্পিউটার সংস্থা এবং গার্মেন্টস সেক্টর থেকে বিজ্ঞাপন নিতে পারি সম্মিলিতভাবে।
ছয় : যা তেজোদীপ্ত, অযাচিত, উপযুক্ত অথচ মনে হয় আপাত অনাকাঙ্ক্ষিত এসবই (লেখা) ছোটো কাগজের বিষয় এবং আঙ্গিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ওই অজ্ঞরা জানে না দুনিয়ায় মিথের প্রথম দুইজন আদম এবং ইভের মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক প্রত্যয়ের প্রথমে এবং নিগূঢ় স্পন্দন— যার সংযুক্তি লিট্ল ম্যাগাজিন ধারণা করে চলেছে।
ডারউইনে সেই কোকিল যে নিজে প্রবল সংযোগে কিংবা সঙ্গমে অন্যকে আহবান করে যে গানটি গেয়ে ওঠে তা নিশ্চিত লিট্ল সঙ্।
সাত : সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে পৃথিবীর দুর্র্ধষ আর দুর্বিনীত কিম্বা পরাজিত বা শোষিত এ দু’শ্রেণীর মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে আত্মস্থ করে ছোটো কাগজ এগিয়ে যায়। মাঝামাঝি যেসব মানুষেরা, যারা সুবিধাবাদী শ্রেণী যাদের সুখ, দুঃখ, আশা, আনন্দ, ভালবাসা, কান্না, প্রেম, আত্মত্যাগ— যা ঝুমুর তালের মতো তাৎক্ষণিক তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল চরিত্রের হয় না তারা পার্শ্ব চরিত্রের। পৃথিবীর প্রথম সঙ্গীত, পৃথিবীর প্রথম চিত্রকলা যখন শুরু হয় বা সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটে তখন তা নিরঙ্কুশ ছিল লিট্ল কিন্তু ক্রমে ক্রমে যখন তা প্রথা মুনাফালোভী ব্যক্তিস্বার্থের ব্যক্তিবিকাশের (অর্থনৈতিক) দিকে এগোতে থাকে তা শেষ পর্যন্ত লিট্ল চরিত্র হারিয়ে বৃহত্তম গণ্ডির আবর্তে বাণিজ্য বিকাশের রূপ নিয়ে সর্বগ্রাহী হয়ে মূল চরিত্র হারিয়ে ফেলে।
আট : মুনাফালোভী সংস্কৃতিবানরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের হাতের আঙুরের মতো অঙুলিগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে এবং কখনও কখনও আমরা পক্ষান্তরে সময় নির্ধারণ করতে অপারগ হয়েছি; কেননা তারা আমাদের করগুলো খেয়ে নিয়েছে। এই ছোটো কাগজ যারা করেন কোনো-না-কোনোভাবে তারা চলতি সব কিছুর বিপরীত। তারা প্রথা বিরোধী। অন্তত শতকরা আশি ভাগ লেখক-কর্মীরা বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ভাঙেন। ছোটো কাগজ আন্দোলনের একজন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনপ্রক্রিয়াও জটিল হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধগুলোকে ব্যক্তিজীবনেও ভাঙতে হয় তাকে। লেখক প্রতিষ্ঠানবিরোধী হয়ে ওঠেন।
‘রবীন্দ্র সাহিত্য পরবর্তী কমার্শিয়াল পোঁদ-ঘষাঘষির পাশপাশি বাংলা ভাষার লিট্ল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।’
সাতশ বছরে বাংলা ভাষার ইতিহাসে সুবিমল মিশ্রের মতো এতো ব্যাপক বেপরোয়া এবং গঠনমূলক ভাঙাচোরা আর কেউ করেননি।
বাংলাদেশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমেদ, আল মাহমুদ, শোয়েব শাদাব, আহমেদ নকীব— এই ভূখণ্ডের কবিতার ভাষাশৈলী নির্মাণ করেছেন, তারা নিজস্ব অভিব্যক্তি প্রদানকারী, তাদের হাতে দিকনির্ণীত হয়েছে। যদিও ভাষার সাম্প্রদায়িকতায় আমরা বিশ্বাসী না, তথাপিও তাঁরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নব্য গন্তব্য।
বিগত কয়েকশ বছরের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান— এটা আমরা বিশ্বাস করি আর গত ৭০ বছরের শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পীর মর্যাদা দিতে চাই আব্বাস উদ্দিন এবং আব্দুল আলিমকে।
নয় : সৌন্দর্যবোধ ও রসবোধ জীবনের সুগভীর অতলস্পর্শী কেবল কোনো কিছু, কিম্বা শিল্পে কেবলমাত্র এই দুটো প্রয়োজনীয় বিষয়— শুধু কী তাই? এর ভেতর কি নিহিত থাকে না মানুষের দায়ভার তৈরি হওয়ার একটা মূল্যবোধও? আর্ট ফর আর্টসেক আর লাইফসেক এই দুটি টার্মস দীর্ঘদিন ধরে এই পরস্পরের সম্পূরক বলে আমি মনে করি। আর্ট ফর আর্টসেক জীবন বাদে কতটুকুই-বা এগুতে পারে? আবার আর্ট ফর লাইফসেক আর্ট বহির্ভূত কী এমনই-বা করবে? জীবনের কোনো কোনো অংশে শিল্পীর নিগূঢ় সচেতন প্রয়াস আনবে— এইতো! আসলেই অনুসন্ধান কোথায়? লিবার্টি। প্রবল স্বাধীনতা। হ্যাঁ, ফ্রিডম চাই। কোনো ম্যানেজের ওপর শিল্প দাঁড়ায় না। অথচ বাণিজ্যধর্মী মিডিয়াতে যে আর্ট হাইলাইট হচ্ছে; লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সচেতনভাবে অসচেতনের ভূমিকা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার নামে কৌশলে তৈরি করে। বাজারী শিল্পকরণিকদের ব্যক্তিমূল্য নেই। যা আছে তাদের কাছে নিজেদের বিনিময় মূল্য।
দশ : রবিঠাকুরের কাছে আমাদের ঋণ আছে সত্য, গদগদ তেমন কিছু নয় তাই বলে, সুরস্রষ্টার চিরকালীন এক মর্যাদাবান শিল্পী তিনি। তাঁর বাণী আর তাঁর গান আর এর অন্তর্নিহিত অনুসন্ধান আমাদের নিয়ে যায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এক মহান শিল্পী লালনের অভিমুখে।
এগারো : যারা নিয়মিত বাণিজ্যিক কাগজগুলোয় লেখে (অবশ্যই তাদের লেখা নান্দনিক একটা মান স্পর্শ করে), প্রতিষ্ঠান হাতের পাঁচ হিশাবে তাদের লেখা নিয়ে বলে, ভালো লেখাটাই বড়ো কথা। আর লেখকরা বলেন, আমাদের লেখার দাঁড়ি, কমা, সেমিকলন যদি হুবহু ছাপে তবে আপত্তি কেন। আমরা আমাদের ব্যাপক রিডারদেরকে বঞ্চিত করবো কেন? জনগণের কাছে সঞ্চিত থাকতে গিয়ে কী পরিমাণ লেখক নিজেই লাঞ্ছিত হন, তা বলাই বাহুল্য। এই লেখকরা সাহিত্য সম্পাদকদের মুখের দিকে তাকিয়ে লেখেন। আহসান হাবিব ছাড়া এ যাবত কোনো উপযুক্ত এবং সৎ (যদিও এই টোটাল প্রক্রিয়ায় কোনো সৎ বা উপযুক্ত সাহিত্য সম্পাদক হবার কথা নয়) কোনো সাহিত্য সম্পাদক নেই। যারাই সাহিত্য সম্পাদক কোনো-না-কোনোভাবে লেখালখির জগতে তারা ব্যর্থ।
এদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে আপনার লেখা তখন নিন্দনীয় হয়ে উঠবে; সমসাময়িক একজন দুর্বল লেখককে দুর্দান্ত বিশ্লেষণে শিল্পী বানিয়ে এরা বিভ্রান্ত রুচির জন্ম দিয়ে আপনাকে ছোটো করে রাখবে। আমরা জানি, বিগত বিশ বছরে মধ্যবিত্ত জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-দর্শনে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। তার জীবনপ্রক্রিয়ার ভেতর, বাস্তবতার ভেতর অনেক সপ্রতিভ অভিব্যক্তি রপ্ত করেছে— এই সব করলেও শিল্প-সাহিত্যের টেস্টের ক্ষেত্রে ওই পুতুপুতু— ধরা, বন্দি হওয়া, ঘোরে-পড়া, এমন ধরনের শিল্পর্কম পছন্দ করে; তাদের তরল রুচি বলবো আমরা। কমিউনিকেটিং লেখা পাঠকরা চায়—পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আর মালিকরা এই কথা বলে ৮০ মিনিটে শেষ হওয়া একটা দৈনিকের সাময়িকীতে ২০ মিনিটের জন্যে কমিউনিকেটিং গদ্য, কবিতা ছাপে। অনেক সময় বিনিয়োগ হিসাবে আধা-সিরিয়াস লেখা দুই-একটা ছেপে অজস্র বস্তাপচা লেখা ছাপার যৌক্তিকতাকে জায়েজ করে। এটা মোদ্দা কথা যে আমাদের দেশে বুর্জোয়ারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে খবরের কাগজ বের করে কেন? এক: তাদের ব্যবসা এবং কালো টাকার ঢাল হিশাবে কাগজটি ভূমিকা রাখে— দুই: এখান থেকে প্রচলিত মূল্যবোধের ওপর ভর করেই সে ব্যবসা করে। একটা বাণিজ্যিক মিডিয়া হাজারটা সিস্টেমের ভেতর দিয়ে চলে। এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে আপনার রয়েছে ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ আপনি লেখক হিশাবে কীভাবে প্রকাশ করবেন দৈনিকের পাতায়? প্রবীণ লেখকরা বলেন, ক্ষোভ খুব ছোটো জায়গায় থাকে। বাণিজ্যিক মিডিয়ার লেখকেরা বলেন, শিল্পিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিরোধ কোথায়? কতোটা সুবিধাবাদী দেখুন তারা, ক্ষোভ নিয়ে সবসময় লিখতে হবে এমন কথা বলছি না। তবে ক্ষোভ শিল্পিত করে লিখতে হবে? এমন ধারা মাথায় নিয়ে তারা লিখতে বসেন। দেখুন, কারা সচেতনভাবে অচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত লেখার ভান করে— এঁরা!
অনেক লেখক আছেন, বাণিজ্যধর্মী কাগজের সাহিত্য পাতায় লেখেন, যে-লেখাগুলো সাহিত্য সস্পাদক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় সেগুলো দিয়ে নিজেরা ম্যাগাজিন বের করে তাকে লিট্ল ম্যাগাজিন বলে দাবি করেন। এরা দুধ-তামাক দুটোই খান। এরা আমাদের বন্ধু না। বরং আমাদের গতিপথে বিভ্রান্তকারী।
অনেকদিন ধরে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে, এরা সাধারণ মানুষের জন্যে লেখে না। এ কথা একদম সত্য না। আমরা ফাইট করছি মিডিয়ার বিরুদ্ধে, গলিত-পচিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে না। জনগণের জন্যে হালকা বিনোদনসর্বস্ব বিষয়টাকে সরিয়ে মূলত জীবনে সৌন্দর্য সৃষ্টির জায়গাটা নিছক এন্টারটেইনমেন্ট না হয়ে এসথেটিক প্লেজারের মাধ্যমে জনগণের চিন্তন প্রক্রিয়াকে এ্যাডভান্সড করানোর একটু সূক্ষ্ম দায়িত্ব লেখকের থাকে বলে আমরা মনে করি।
বারো : পেশা : মানুষের ব্যক্তিত্বের ওপর পেশার ছাপ পড়ে। এটা সবাই জানে। একটা সোসাইটি যখন পলিউটেড হয় তখন একটা শিশুও তার দায়ভার থেকে বাঁচতে পারে না। সে যে কৌটোর দুধ খায় তা অনেক ক্ষেত্রে নানা দুর্নীতির ভেতর দিয়ে আসে। সেখানে পেশা নির্ধারণ করা মুশকিল। তবে যা সরাসরি ছোটো কাগজ মুভমেন্টকে ক্ষতি করে এমন পেশা থেকে দূরে সরে থাকবো। প্রশ্ন— চারপাশে চলমান যে প্রথা তার প্রতি বিরোধটা কেন? ব্যক্তিগত জীবন-যাপনে একটা পর্যায় পর্যন্ত আমরা নানামুখী প্রভাবময় এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে জীবন ধারণ করতে পারি— যদি আমরা চলমান মূল্যবোধকে মেনে নিই। এই প্রথাকে পুরোপুরি মেনে নিই। কিন্ত একজন সচেতন লোক কেন এটাকে মেনে নেয় না? কেন? কারণ তার ব্যক্তিগত সুখগুলো সে যে প্রক্রিয়ায় অর্জন করে তা নৈতিক এবং সুন্দর না— তা এই কারণে যে, অন্যের রেশনিং কেটে সে অদ্ভুত দায়-দায়িত্বহীন মনোবৃত্তি নিয়ে একটা কথিত স্বস্তিদায়ক জীবনের পেছনে ছুটতে থাকে। এটা ক্রাইম। এক পর্যায়ে যে ক্রাইম করেছে সে নিজেও তা বিশ্বাস করতে চায় না। অধিকাংশ মূল্যবোধ যেগুলো নিয়ে চলমান প্রথা তৈরি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে এক্সপ্লয়টেশন। কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা তাদের প্রয়োজনে এই প্রথা টিকিয়ে রেখেছে। যার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে সপাং সপাং চাবুক খেতে হচ্ছে। এই যে এক্সপ্লয়টেড হওয়ার সিস্টেম এরই জোটফল নিয়ে স্টাবলিশমেন্ট হয়। এটাই প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা মনোভঙ্গি, একটা আ্যটিচ্যুড, একটা নিরন্তর কোশ্চেন, নিজেকে ভাঙ্গা, নিজের বিরুদ্ধে লড়া, নিজস্ব রুচি তৈরি করা। আর তার প্রয়োজনে নিজস্ব নন্দনের প্রয়োজনীয়তা বোঝা।
তেরো : বহুলোক মনে করেন অপেক্ষাকৃত সৎভাবে সচ্ছল থাকাটাও বোধ হয় প্রাতিষ্ঠানিক জীবন-যাপন। তারা মনে করেন, না খেয়ে থাকা, উস্কোখুস্কো চুল, আর অপরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট পরে সারাদিনক্ষণ উঞ্ছবৃত্তি আর গাঁজা-মদ-হেরোইন আসক্ত থেকে, কোনো যূথবদ্ধ শ্রমের সাথে যুক্ত না থেকে জীবন পারাপারই বোধহয় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। আমাদের কাছে এগুলোকে অনেক সময় প্রতিবাদের মতো মনে হলেও এগুলো আসলে ক্রেজ। ঠিক কোথায় আঘাত করতে হবে আমরা সেই লক্ষমুখ সনাক্ত করবো ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশান দিয়ে। ফলে একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী যথেষ্ট সচেতন। শুনে রাখুন, সচেতনতাকে প্রতিষ্ঠান একদম পছন্দ করে না। আপনাকে কম বুদ্ধির লোক করতে পারাই তার লক্ষ্য। অবোধ-আজগুবি-উদ্ভট-কথিত কল্পনাকে প্রতিষ্ঠান তারিফ করে তার ওপর লেবাস লাগায়। একজন প্রাতিষ্ঠানিক লেখক একবার আমাদের বলেছিলেন, একজন পাগল তোমাদের চেয়েও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। কেননা সে এই সমাজে সবকিছুতে উদাসীন। বোঝা যায় পাগলের উদাসীনতা প্রাতিষ্ঠানিক লেখকটির পছন্দ অথচ এই উদাসীনতা কোনো সচেতন লোকের কাম্য নয়। সে সমাজে বাস করলেও সামাজিক ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব সে নেয় না। ফলে পাগল সামাজিকভাবে শিকার। তার সচেতন কোনো বিরোধিতা নেই।
চৌদ্দ : আমরা মনে করি পরিবার হলো সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। আমাদের সমাজে মা’কে সংসারে সবচেয়ে বেশি এক্সপ্লয়েট করা হয়। ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া বুকের চাম’ এসব কথা বলে মাকে সংসারে ঠকানো হয়। আর সন্তানরা দাবির দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন মাকে শুষে নিয়ে রক্তচোষার মতো বড় হয়েছে। মায়ের ব্যক্তিজীবন— একটু বয়সে ধর্মের কাছে নুয়ে পড়া ছাড়া আর কিছুর ভেতর নেই। এইসব যা কিছুর ভেতর দিয়ে পরিবার যে মূল্যবোধগুলো নিয়ে এগোয়, সেগুলো সামাজিক প্রথার প্রথম স্কুল। পরিবারের প্রতি বিরোধিতা আমাদের রয়েছে। পরিবার, পরিপার্শ্ব, মিডিয়া এইসব কিছুর প্রতি শুধুমাত্র বিরোধিতাই কি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা? আগেই বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা মনোভঙ্গি। পরিবার পরিপার্শ্ব-মিডিয়ার বিরোধিতা (রেডিও, টেলিভিশন, দৈনিক সাহিত্য সাময়িকীর পাতার) এই কারণে, যে মূল্যবোধের জোটফল দিয়ে তাদের এই সিস্টেম— তা যেভাবে তৈরি হয়েছে এবং তাকে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে অজস্র মানুষের রক্তের বলির ভিতর দিয়ে। আর মিডিয়ায় ব্যক্তিলেখকের স্বাধীন বিকাশ ইচ্ছেমতো কখনই হয় না। মিডিয়া সুকৌশল নির্ধারণ করে লেখকের সত্তাকে।
তারা লেখককে মোটা অংকের টাকা দেয়। পুরস্কার দেয়। পুরস্কারগুলো খ্যাতিমান হিশাবে লেখককে সামাজিক স্বীকৃতি এনে দেয়। এই পুরস্কারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এরা প্রথাবিরোধী কোনো লেখককে সচরাচর সম্মানিত করে না। মনোরঞ্জনকারী আর ম্যাড়া লেখকদের ডেকে এনে পুরস্কৃত করে— উদ্দেশ্য —জনগণের সামনে একটা আইডিয়াল হিশাবে ওই ম্যাড়া লেখককে রাখা। বেশ কয়েকবার এই রকম চলার পর গুঞ্জন উঠলে প্রতিষ্ঠান তখন একজন সম্ভাবনাময় লেখককে হঠাৎ রাজি করিয়ে পুরস্কার দিয়ে দেয়, যাতে সবার মুখ বন্ধ থাকে।
পনেরো : পুরস্কার সস্পর্কিত : প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার অবশ্যই আমরা বর্জন করবো। পুরস্কার বহু রকমের আছে— আমরা সেগুলো বলছি না। একজন মানুষ তার বন্ধুদের দ্বারা তার পরিপার্শ্ব দ্বারা তার পাঠকদের দ্বারা নানারকম ভালোবাসা মর্যাদা নিতে পারে। সেটা ভিন্ন। যদিও সেটাও এক অর্থে পুরস্কার। কিন্তু যে পুরস্কার প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞায় পড়ে অর্থাৎ পুরস্কার যেখানে থেকে দেয়া হয় সেটা— প্রথাসম্বলিত প্রতিষ্ঠান। যারা বিচারক তারা চলমান মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়েই বিচার করে। মোটা অংকের টাকা এবং সম্মান দেয়া হয়— যা দিয়ে লেখক একটা শ্রেণীতে ওঠেন এবং সামাজিক সুযোগ সুবিধার প্রচুর সুযোগ পান। রাষ্ট্রের গণ্যমান্য মানুষ হিশাবে স্বীকৃত হন। প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কেবল সেটাই।
অনেকেই বলেন সে-তো কোনো লবিং করেনি। একাডেমি তার বইটা পড়ে মূল্যায়ন করেছে। হ্যাঁ এই ক্ষেত্রে আমরা ভাবি, লেখক ধরা যাক তা না জানেন, তার শুভাকাক্সক্ষীরাও যদি নাও জানেন, ঘরে বা বাইরে যদি মদের পার্টি না-ও হয়ে থাকে— তারপরেও লেখক যদি পুরস্কার পান তবুও বলবো লেখক এই সিস্টেমের এগেনেস্টে তথাকথিত শিল্প ছাড়া আর কিছু করেনি। তিনি রাইটিং-এ কম্প্রোমাইজ করেছেন। একাডেমি চলছে পুরনো ক্লিশে পশ্চাৎপদ রক্ষণশীল মূলবোধের ওপর। লেখাটি তার বাইরে ছিলো না। এ-বিষয়ে আমরা প্রয়াত কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিঠি—হাসান আজিজুল হকের প্রতি—‘নিরন্তর’পত্রিকায়— তাতে স্পষ্ট পুরস্কার সম্পর্কিত যে মন্তব্য রয়েছে তা আমাদের চিন্তার সাথে একান্ত হয়।
ষোলো : সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদক : সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক ক্ষমতায় সর্বেসর্বা নন। তিনি পত্রিকার মূল সম্পাদকের অঙ্গুলি-নির্দেশে চলেন। তিনি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের রুচি আত্মস্থ করেন, প্রয়োজনে প্রকাশকেরও। এবং সেই অনুপাতে লেখক সাহিত্যিকদের নির্বাচন করেন এবং কৌশলে ব্যবহার করেন। ফলে লেখকের হাত-পা বাঁধা থাকে।
অধিকাংশ সাহিত্য সম্পাদক মদ্যপ, নারীসঙ্গলিপ্সু এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকে। তারা চিত্রকরের কাছ থেকে পেইন্টিং উপহার নেয়—বিনিময়ে তাদের ফলাও করে লেখা ছাপে। এই পেইন্টিং নেয়ার মূল উদ্দেশ্য চাকরি থেকে রিটায়ারের পর গ্যালারি করে পেইন্টিংগুলো বিক্রি করবে। ভাবুন কত নির্লজ্জ তারা! আর এই ধরনের লোকের বাড়িতে লেখকদের বাজার পর্যন্ত করে দিতে হয়। তারপরও এই সাহিত্য সম্পাদকের আওতাধীন হয়ে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েও লেখকরা লেখেন। এরাই প্রতিষ্ঠানের পোষমানা লেখক। খেয়াল করে দেখুন, কোথাও যেন এদের দুই একটা লেখা আপনারও ভালো লাগে। সাবধান! আপনার রুচিবোধকে সতর্ক রাখুন।
সতের : বিজ্ঞাপন নেয়া সংক্রান্ত : অবশ্যই ছোটো কাগজের কর্মীদের মাল্টিন্যাশনালের বিজ্ঞাপন নেয়ার কথা না। কেন-না ম্যাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো শোষণ করে তাদের নিজস্ব পণ্যের প্রশ্নে এবং আমাদের মৌলিক উৎপাদন ব্যাহত করে। জাতীয় আয়কে ভারসাম্যহীন করে। তাদের বিজ্ঞাপন ছাপা কখনও সংগত নয়। বরং আগে বলেছি অপেক্ষাকৃত দোষযুক্ত থাকা সত্ত্বেও এমন দুটি ক্ষেত্র থেকে আমরা বিজ্ঞাপন নিতে পারি যারা আমাদের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করেছে ১। গার্মেন্টস বা পোষাক শিল্প ২। কম্পিটারের সফটওয়ার। প্রত্যেকটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে এবং প্রত্যেক কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন নেয়া যেতে পারে অন্তত আমরা যতগুলোকে চিনি। এদের সাথে আমরা আলাপ করতে পারি সামগ্রিক বিষয় নিয়ে। এরা সস্তায় শ্রম কিভাবে ক্রয় করে সেগুলোও লক্ষ্য করতে পারি, আলাপ করতে পারি তা নিয়েও। আমরা বিশ্বাস করি পুরো বিষয়টি নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে যদি এগোনো যায় পত্রিকা প্রকাশের বিষয়টি তখন সহজ হয়ে যেতে পারে।
আঠারো : বই প্রকাশ প্রসঙ্গে: আমরা লক্ষ্য করছি ব্যক্তিগতভাবে বই বের করা এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী বা পরিবারের কাছ থেকে কষ্টেসৃষ্টে বড়োজোর একটা বই করতে পারা যায়। এর পরের বই প্রকাশ করা কিভাবে সম্ভব? একটা বিষয়ে আমরা ভাবতে পারি, কমার্শিয়াল বই যারা বের করেন অবশ্যই সেখানে বই দেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে এমন কিছু প্রকাশক আছেন যারা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিষয় নিয়ে ততটা সতর্ক নন তবে কখনই তারা সস্তা বাজারী পচা বা নিুমানের বই প্রকাশ করেন না— সেইসব প্রকাশকদের সংগে আলাপ করা যেতে পারে (এ রকম প্রকাশক সংখ্যায় কম নয় তবে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তরুণ লেখকদের প্রতি আগ্রহী হন না)। চেষ্টা করে রাজি করানো যেতে পারে। পুরো বিষয়টি যূথবদ্ধতার আওতাভুক্ত। নিজেরা মিলে সমবায় ভিত্তিতে প্রকাশনী করা সবচেয়ে ভালো। আর বইয়ের কস্টিং কমিয়ে আনতে হবে। এতো ঝলমল বইয়ের দরকারই-বা কি? দু-একটা হলে ভালো— না-হলে না।
উনিশ : প্রসঙ্গ জানানো এবং প্রচার : আমরা আমাদের সম্পর্কে আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে চাই তথ্য অর্থে, সংবাদ অর্থে আর অবগত অর্থে— সেই জানানো মানে কেবল বলা, প্রচার কিম্বা পণ্য বেচার অর্থে নয়— ওই জানানোটুকু এ জন্যই যে, আমরা যেন কখনই এন্টি-পিপ্ল না হই—তাই সংবাদপত্রে প্রজ্ঞাপিত অর্থে নিজেদের বই পত্রিকা নিয়ে ঘোষণা দেয়া বা বক্তব্য দেয়া ইশতেহারভুক্ত। এইভাবে প্যারাগ্রাফ করে আলাদা আলাদা করে বলার কিছু নেই। অবশ্যই ছোটো কাগজ সংক্রান্ত কোনো গঠনতন্ত্র কিম্বা সংবিধান রচনা করার অভিপ্রায়ও আমাদের নেই। বিষয়টা যেহেতু বিমূর্ত না তাই এর অবয়ব দরকার। অন্তত একটা আদল দরকার। ধ্যান-ধারণা আপনারই, জ্ঞানও আপনার, এমনকি সৃষ্টিও—আমাদের কথা হলো কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আপনি— আমি কথাগুলো বলছি— এজন্যই বিশ্লেষণ। চারিপাশে সেই ঘ্যান-ঘ্যান করা একই কথা, দেশে শক্তিশালী সাহিত্য পত্রিকা কই? দেশে শক্তিশালী স্টাবলিশমেন্ট কই? আমাদের উত্তর : শক্তি কথাটি অসীম শব্দ এর কোনো পরিমাপ নেই। দেশ বা আনন্দবাজার একমাত্র স্টাবলিশমেন্টের আদর্শ না। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা পুরো জীবন দেখার আর জীবনপ্রক্রিয়া বোঝার একটা মনোভঙ্গি। একটা নিরন্তর প্রশ্ন আর অনুসন্ধান। দুর্বৃত্ত পুঁজির যে কোনো কার্যক্রমের বিরুদ্ধে লড়া। ছোটো কাগজের লেখায় সেই জীবন অনুসন্ধানের প্রকাশ পায়। বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, এফডিসি, টেলিভিশন, রেডিও প্রভৃতিসহ দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর পাতা এখন যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আপনি যদি স্বীকার না করেন— ভাববো আপনার নিজের স্বার্থে আপনি এগুলোকে প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকার করছেন না। বারবার আমরা বলতে চাই নিজেকে প্রশ্ন করেন, আত্মানং বৃদ্ধি, নো দাই সেলফ্— নিজেকে অনুসন্ধান করে দেখে নেয়া, তারপরে হাঁটা। আর যদি একাত্তরের মতো আরেকটা যুদ্ধ হয়, ভারত-বাংলাদেশের যদি যুদ্ধ হয় কিম্বা কোনো অভ্যন্তরীণ গণঅভ্যুত্থান দেশে যদি ঘটে সেইক্ষেত্রে আমাদের প্রথম যুদ্ধ হবে অভ্যন্তরীণ মিডিয়া কেড়ে নেয়ার জন্য— এই ছাড়া সংস্কৃতি নিয়ে বাণিজ্যিক মিডিয়াতে যাওয়ার প্রশ্ন কখনই ওঠে না।
বিশ : যুক্তির শৃংখলা দিয়ে কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে কিম্বা অহেতুক ধোঁয়াশা কিছু বলার মতো প্রয়োজন বা অবকাশ নেই, একথা সত্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভঙ্গি এখন ঘরে ঘরে জরুরি হয়ে পড়েছে। অজস্র বিষয় নিয়ে প্রশ্ন আছে আর আছে প্রতর্ক-বিতর্ক। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় কিম্বা সেই গল্পটার মতো : কাঠ-পেনসিলকে দেখে ইঁদুরের বাচ্চা যার নতুন দাঁত উঠেছে, সে বললো, তোমাকে আমার কামড়াতে ইচ্ছা করছে; কাঠ পেনসিল বললো, আমাকে একটু সময় দাও। আমি একটা জিনিস আঁকি। ইঁদুরের বাচ্চা লক্ষ্য করতে লাগলো। আর কাঠ-পেনসিল যা আঁকছিল তা দেখে ইঁদুরের বাচ্চা ইতস্তত কম্পিত হতে লাগল এবং এক পর্যায়ে চিৎকার করে বললো, বাব্বা এ যে বিড়াল— বলে ভোঁদৌড়। আমাদের যুক্তির পাল্টা যুক্তি ইঁদুরের সামনে বিড়াল দেখিয়ে ভয় দেখানো না। প্রচুর যুক্তি-তর্ক নিয়ে এগিয়ে আসুন। আমরা আলোচনা করবো। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করুন, এই টোটাল মনোভঙ্গিতে আপনার লেখা প্রথাসিদ্ধ এবং বাণিজ্যধর্মী কাগজের লেখকদের তুলনায় অবশ্যই আলাদা হবে— আমরা তা জানি, কিন্ত লেখাটা কেমন হবে তা কখনও লেখককে বলা হবে না—বুঝি শুধু পাল্টা লেখা হবে ব্যাস—লেখক নিজে প্রথমে তা জানতে পারবেন, তিনি নির্ধারণ করবেন তার নিজের লেখা। আমরা মনে করি যার যার সৃজনশীলতা তারই নিজস্ব অভিব্যক্তির প্রকাশ। তার আপন বোধ বলে দেবে তার বিষয় এবং আঙ্গিক কেমন হবে। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই। এটা তাকে, কেবল তাকেই খুঁজে নিতে হবে।
8.
সাহিত্যের কোন অর্থমূল্য হয় না- হতে পারে না। এ জন্য যদি সকলে লেখালেখি ছেড়ে দেয় দিক। সাহিত্যে ও শিল্পে কোন কমপ্রোমাইজ করা উচিৎ না। যারা ভালোবাসার টানে সাহিত্যকে আত্মার আত্মীয় বানাতে লেখালেখি করবে- তাদেরই লেখক হওয়া উচিৎ। তাহলে ‘কে লেখক আর কে লেখক না’(?) এই প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না পাঠক সমাজ। কোন বইটি পাঠ্য আর কোনটি অপাঠ্য এই দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে বই না কিনে বাড়ি ফিরে আসতে হবে না।
এখন সাহিত্যিক সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে এক বা একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা লিটলম্যাগ ঘিরে পত্রিকার ভেতর/বাইরে মিলিয়ে একটা ক্ষমতাবলয় যার মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকেন সাহিত্যের অধ্যাপক, ক্ষমতাধর বুদ্ধিজীবী, যশোপ্রার্থী সাহিত্যিক ও উচ্চাভিলাষী আমলা ইত্যাদি নিয়ে। এই ফর্মেশন থেকে নতুন এক ধরনের সাহিত্যিকের দেখা মিলতে লাগল যারা সমাজে/কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত, পরীক্ষিতভাবে বিশ্বস্ত, কনফর্মিস্ট, আন্তঃপ্রজন্ম যোগাযোগে পারঙ্গম, লেখার টেবিল থেকে সমঝোতার টেবিল সর্বত্র দৌড়ঝাঁপে সমান অক্লান্ত। এরাই কর্পোরেট সাহিত্যিকদের প্রথম প্রজন্ম। এদের ডোসাইল ভঙ্গি, আদব-লেহাজের বিশেষ ধরন আর খানিক উদাস খানিক অনিশ্চিত ভাবটি হলো হিমশৈলের চূড়া, আর এই লাজনম্র শাবকটিকে নিচ থেকে সাহিত্য-সাগরে ভাসিয়ে রাখছে বাজারি সাহিত্যিক সিন্ডিকেট।
প্রায়ই পাঠকদের বলতে শোনা যায়, বর্তমান সাহিত্যের ধার কমে গেছে। খুবই সত্যি কথা। কেননা বর্তমান সময়ের সাহিত্যে জীবন হয়ে উঠছে নৈবেত্তিক। গল্প-উপন্যাসগুলো খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা হচ্ছে। জীবনদর্শনের বালাই থাকছে না সেখানে। কোন লেখা শুরু করার আগেই লেখক ভাবতে থাকেন পরবর্তী লেখা নিয়ে। প্রতিটি কাজ হয়ে উঠছে দায়সারা গোছের।
বর্তমান সময়ের লেখক-কবিদেরকে অতীতের বিভিন্ন সময়ের শ্রেষ্ঠসাহিত্য কর্মগুলোকে গুরুত্ব সহকারে পড়তে হবে, তাদের ঐতিহ্যকে অনুধাবন করে নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অন্যদের ভালো করে রপ্ত করা মৌলিকতার অন্তরায় নয়। 'ঘড়ঃযরহম রং হবি ঁহফবৎ ঃযব ংঁহ’- স্যামুয়েল বেকেটের এই কথাটি সাহিত্যে খাটে না। বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, যে তিনি জীবনানন্দের মত লিখতে চান কিন্তু পারেন না। প্রত্যেক লেখকেরই একটা নিজস্ব ঢঙ আছে। এক্ষেত্রে, অন্যদেরকে যত বেশি জানা যাবে নিজের ঢংটা এজন্য কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, হুমায়ূন আহমেদের মতন বিনোদনধর্মী লেখকরা রাতারাতি তারকা বনে যাচ্ছেন। প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ের কথা মাথায় রেখে এ ধাঁচের লেখকদের পেছনে ছুটছে বেশি। বই এখন হয়ে উঠেছে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, বাবা দিবস, মা দিবস, বন্ধু দিবস, ভালোবাসা দিবস- প্রভৃতি দিবসের উপহার বিশেষ।
আমরা জানি, চাহিদার ভিত্তিতে বাজারের চরিত্র পরিবর্তিত হয়। তাই, এক্ষেত্রে, পাঠকরাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সময়ে মানুষ ছুটছে অর্থের  পেছনে। আজকের প্রজন্ম খোরাক বলতে শুধু দেহের খোরাককেই বোঝে, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান। মনের খোরাক বলতে পেট পুরে খাওয়া, ভালো ভালো পোশাক পরা আর এসি রুমে ঘুমানো; ঘুরে ফিরে যাহাই নারিকেল গাছ, তাহাই ডাব গাছ! চিঠি লেখার যুগ গত হয়েছে। এখন চলছে মুঠোফোনের যুগ। আবেগ হয়েছে পান্সে, সস্তাও। মধ্যবিত্ত বাংলাদেশ শেকড়হীন তলকে বেড়াচ্ছে ভোগের বাজারে। ধর্মের লেবাস জড়িয়ে কড়া নাড়ছে ক্ষমতার রাজনীতিতে।
জনপ্রিয়তা ও অর্থের  মোহ তাঁদের লেখক সত্তাকে বিষিয়ে তুলেছে। সাহিত্যের প্রতি কারো কোন কমিটমেন্ট নেই। শিল্পের জন্য স্বার্থত্যাগ কথাটিকে তাঁরা একুশ শতকের অভিধান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। লেখকরা এখন তাঁদের বিবেকের মৃত্যু ঘটিয়ে ক্ষমতাশীল দলের পোষা তোতাতে পরিণত হচ্ছে। বিপরীত স্রোতে যাঁরা থাকছেন তাঁদের সংখ্যা এবং ক্ষমতা এতই কম যে তাঁরা তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষা করতেই হিমশিম খাচ্ছে।
ছোটকাগজের পড়হপবঢ়ঃ-টা একদিনে অঙকুরোদগম হয়নি; বেশ সময় নিয়েই বাংলা সাহিত্যে এর আবির্ভাব। ছোটকাগজের মূল্যায়ন পৃষ্ঠা কিংবা পাঠকের সংখ্যা গুণে করা সম্ভব না। ছোটকাগজ লেখক তৈরী করে। আসলে কাউকে পিটিয়ে কিংবা ভুলিয়ে লেখক তৈরি করা যায় না। ছোটকাগজ, এক্ষেত্রে, একটা সংযোজক সেতু হিসাবে কাজ করে। এটা লেখকদের জন্য প্রচলিত নিয়ম ভাঙার কিম্বা এক্সপেরিমেন্টের জায়গা।
আমার কাছে, ছোট কাগজ হচ্ছে একটি ট্রাজিক হিরো নয়। কেননা, এরিস্টটল তার পোয়েটিকস- আচরণ এর  যে বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়েছেন তার বেশিরভাগই ছোটকাগজের সাথে মিলে যায় । ছোটকাগজের জন্মই হয় অকালমৃত্যুর জন্য, ভাগ্য তার সাথে করে বিরুদ্ধাচরণ। ছোটকাগজ ধারন করে প্রতিষ্ঠিত নিয়মকে নস্যাৎ করবার অকৃত্রিম মেজাজ।

আপাত অগ্রসর ছোট কাগজের লেখকশিল্পীদের একটু আলাদা আঙ্গিকে তুলে ধরার জন্য দ্রষ্টব্য প্রথমবারের মতো ছোট কাগজে ক্রোড়পত্রের ধারণার সূত্রপাত করে। যার মাধ্যমে ছোট কাগজের পাঠকের চিন্তায়ায় জগৎকে আলোড়িত করতে তুলে ধরে গল্পকার কাজল শাহনেওয়াজ (দ্রষ্টব্য-৪, ১৯৯৩), কবি শান্তানু চৌধুরী (দ্রষ্টব্য-৫, ১৯৯৫), চিত্রশিল্পী শাহীনুর রহমান (দ্রষ্টব্য-৫, ১৯৯৫), মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দ্রষ্টব্যের নিবেদন (দ্রষ্টব্য-৬, ১৯৯৬)। আরও কর্মসূচির মধ্যে দ্রষ্টব্য ১ম সংখ্যা থেকেই বাংলাদেশের শহর-মফস্বলে বের হওয়া ছোট কাগজগুলোর চিন্তাা-চেতনা, দ্বিধা-দ্বন্দ, বাধা-বিপত্তি এসব নিয়ে আলোচনা তুলে ধরে বিভিন্ন সংখ্যায়। চালচিত্র সম্পাদক রাজা সহিদুল আসলাম (ঠাকুরগাঁও), (দ্রষ্টব্য-১, ১৯৯২), লিরিক সম্পাদক এজাজ ইউসুফী (চট্টগ্রাম) (দ্রষ্টব্য-২, ১৯৯২) বিপ্রতীক সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকী (বগুড়া) (দ্রষ্টব্য-৩, ১৯৯৩), গান্ডীব সম্পাদক তপন বড়–য়া (ঢাকা) (দ্রষ্টব্য-৪, ১৯৯৪), অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ (ঢাকা) (দ্রষ্টব্য-৫, ১৯৯৫)।

সাহিত্যের নান্দনিক সৌন্দর্যের থেকে দামী গহনা গাড়ী মানুষের কামনার জায়গাটিকে দখল করে নিয়েছে। এখন সাহিত্যকেই তার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সাহিত্যের অন্যতম মাধ্যম হল কাগজ এবং বড়কাগজ যেহেতু বাণিজ্যের কথা চিন্তা করে তাই সে কখনোই এগিয়ে আসবে না। ছোটকাগজকেই সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
ছোটকাগজ আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনে দাঁড় করাতে হবে।

কথা সাহিত্যিক সেলিম মোশের্দের সঙ্গে। তিনি বললেন– “আমরা একটা বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সচেতনতাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেছিলাম এবং তার প্রতি এখনো দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছি। প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের কোন রকম প্রলোভনেই গা না ভাসিয়ে এখনো লিখে চলছি। বিপ্লবী যে কোন কাজ করতে হলে চিন্তার একটা ডিসিপ্লিন অবশ্যই থাকতে হবে। তবে একটা কথা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই যে, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা বা বিকল্প সংস্কৃতি দাড় করানো প্রধান অন্তরাই হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনগুলোর নৈরাজ্যবাদী চিন্তা–কাঠামো। বিকল্প সংস্কৃতি শক্তিশালী না হলে বিকল্প রাজনীতিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে না। তাই সকল নৈরাজ্যবাদী চিন্তাকে বাদ দিয়ে বিকল্প একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরীর জন্য বিকল্প সংস্কৃতির যে প্রযোজনীয়তা তা সঠিকভাবে উপলব্দি করে এগুতে হবে। বিশুদ্ধ বিশুদ্ধ সাহিত্য করবো বললেইতো আর সমাজ পাল্টে যাবে না।’’(২৩)

9.
লিটল ম্যাগাজিন আর লিটারেচার ম্যাগাজিন এক জিনিস নয়। বলা যেতে পারে, সব লিটল ম্যাগাজিনই লিটারেচার ম্যাগাজিন কিন্তু সব লিটারেচার ম্যাগাজিন লিটল ম্যাগাজিন না।
আশি, নব্বই ও শূণ্য-এর দশকে যে কয়েকটি পত্রিকা ছোট কাগজের আদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তা হল :অধুনা, একবিংশ, নিরন্তর, গান্ডীব, সংবর্ত, নিসর্গ, সংবেদ, লিরিক, দ্রষ্টব্য, রোদ্দুর, নদী, রিভাইব, অনিন্দ্য, দ্বিতীয় চিন্তা, প্রাকৃত, প্রসূন, চিহ্ন, ধমনি, প্রতিশিল্প, প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।এদর বেশিরভাগই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছোটকাগজ থেকে মেগাকাগজে পরিণত হয়েছে। সরকার আশরাফের নিসর্গ এখন প্রতিষ্ঠিত- বড় মাপের লেখকদের লেখা ছাপে।
শহীদ ইকবাল সম্পাদিত চিহ্ন তের সংখ্যা পর্যন্ত ছোটকাগজের আদর্শগত দিকটা আকড়ে ছিল, কিন্তু প্রচলিত স্রোতে চিহ্নও এখন মেগাসাহিত্য পত্রিকা।
“লিটল ম্যাগাজিনের আরেক সম্পাদক কামরুল হুদা পথিকের সাথে কথা হচ্ছিল। কথার এবটা সময় বললেন– “পুঁজি ও মুনাফা মনস্কতার বাইরে আমাদের এ প্রয়াস। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্য থেকেও এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ঐ ব্যবস্থার উচ্ছেদের ভাষায় লিখে চলছি। এটাই আমার লড়াই।১৯৯২-এ কামরুল হুদা পথিকের সম্পাদনায় বের হয় তাৎপর্যপূর্ণ কাগজ দ্রষ্টব্য। এর শ্লোগানটি আকর্ষণীয় : ‘ঘেন্না  মৌলবাদ, সুবিধাবাদ, গোয়েবল্সবাদ আর শাদা মুখোশপরা ভন্ডদের প্রতি’।” বাংলাদেশের ছোট কাগজ আন্দোলনের দীর্ঘ সময়ে যাত্রায় যে পত্রিকাগুলো একটি বিপ্লবী কাজ সম্পাদন করে গেছে বা যাচ্ছে বলে মনে করা হয় তাদের মধ্যে গান্ডীব, অনিন্দ্য, সংবেদ, পেঁচা, খুন, চর্যাপদ, দ্রষ্টব্য, নিসর্গ, প্রতিশিল্প, দুয়েন্দে, শিরদাঁড়া, জঙশন, সূর্যঘড়ি, চারবাক, ল্যাম্পপোষ্টসহ আরো অনেক কাগজ, যারা লেখা-লেখির মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার এক বিরুদ্ধতা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন। যদিও এখন প্রায় প্রতিদিনই লিটল ম্যাগাজিন নাম করে অনেক কাগজই ছাপা হচ্ছে, যা ন্যূনতম দায়বদ্ধতারও ধার ধারে না। বিজ্ঞাপনে ঠাসা সেই কাগজে কোন নিরিক্ষা নেই, নেই সমাজ বদলের বিকল্প সংস্কৃতি ভাবনার কোন ১৯৮৫-তে লিটলম্যাগ চর্চাধারায় খোন্দকার আশরাফ হোসেন উপস্থিত হন একবিংশ নিয়ে। মৌলিকত্ব ও মনন নিয়ে সমৃদ্ধ একবিংশ। এটি কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্যের কাগজ। ২০১৩-তে সম্পাদকের অকালমৃত্যুর পরও এটি এখনো প্রকাশিত হচ্ছে। এর আটাশটিরও বেশি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। তবে একবিংশ-সম্পাদকের একটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করি :
 ‘বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার আগেই বিদ্ধস্ত হয়ে যাচ্ছে – এ-ঘটনা দুঃখজনক, কিন্তু সত্য। গত কয়েক বছরে প্রচুর সম্ভাবনাময় সাহিত্যপত্র আত্মপ্রকাশ করেছে; একসময় মনে হয়েছিল, এবার একটি রেনেসাঁস আগতপ্রায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। মুষ্টিমেয় কাগজ নিজের অসিস্ত¡¡ বাঁচাতে প্রবলভাবে লড়াই করছে, অথচ বাজারি রম্য পত্রিকাগুলোর রং-বাহারের আশনাই থেকে চোখ ফেরানো যায় না। অপসংস্কৃতি এখন গণসংস্কৃতি হতে চাইছে, স্বল্পশিক্ষিত আনপড় পাঠকদের আত্মা ক্রয় করার জন্য মাঠে নেমেছে হরেকরকম মুখোশপরা মেফিস্টোফিলিস। সন্দেহ কী, জাতি হিসেবে আমরা এগোচ্ছি, উপজেলা পদ্ধতির মতোই ‘আনন্দহি কেবলম’ সাধনমার্গেরও বিকেন্দ্রীকরণ চলছে। বিজ্ঞাপনদাতারা সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদকদের করুণকণ্ঠে জানিয়ে দেন, ‘সরি ভাই বাজেট নাই’, তখন তাদের টেবিলে রঙচঙে বহু ডিজাইন সিনে পত্রিকাগুলোতে যাবার জন্য অপেক্ষায়।’(বাংলাদেশের লিটলম্যাগ : রচনাদর্শ ও গতিপ্রকৃতি:শহীদ ইকবাল, কালিওকলম)(২৪)

লিটল ম্যাগাজিন যে কোনো দেশের যে কোনো জাতির সাহিত্যচর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এসব ম্যাগাজিনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, তরূণ লেখকদের পরিচিতি, সাহিত্য নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। বাংলা ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে লিটিল ম্যাগাজিন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।বাংলাদেশে প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কাগজগুলো হলো সংসপ্তক (১৯৬২), বক্তব্য (১৯৬৩), স্বাক্ষর (১৯৬৩), স্যাড জেনারেশন (১৯৬৩), যুগপৎ (১৯৬৩), সাম্প্রতিক (১৯৬৪), কণ্ঠস্বর (১৯৬৫), ছোটগল্প (১৯৬৬), কালবেলা (১৯৬৫), না (১৯৬৭), বহুবচন (১৯৭০), স্বদেশ (১৯৬৯), শিল্পকলা (১৯৭০), শব্দের বিকৃতি (১৯৬৯) প্রভৃতি।(২৫)

সম্প্রতি, দ্বিতীয় দশকখন্ডে, দেখা যাচ্ছে একদম নতুন প্রবণতা। লিটল-বিগ কোনোটাই নয়, এমনকি কাগুজে বেড়াল-ব্যঘ্র-সিংহস্বভাবী কোনো পত্রিকা নয়, লেখক উঠে আসছেন অনলাইন প্রকাশনা মারফত। বড়-ছোট কোনোপ্রকার কাগজেরই পৃষ্ঠপোষকতা-ধাত্রিগিরি ছাড়া, সম্ভবত, দ্বিতীয় দশকের সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ। মুক্ত, অবারিত, বহুবিধমাত্রিক সেইসব পাব্লিক্যাশনে এই সময়ের বুদ্ধি-সৃজন-মনন সমস্তকিছুর হার্মোনাইজেশন সম্ভবপর হচ্ছে একই পরিসরে। এইসব প্রকাশনার সংযোগসুবিধা ও প্রকাশনীতি ভিন্ন হওয়ার ফলে এখনকার সাহিত্যে আকর্ষন অভাবিত রকমের বেশি ও বৈচিত্রবহ। কন্টেন্টেও পরিবর্তন এসেছে, ট্র্যাডিশন্যাল সাহিত্যচর্চ্চার বাইরেই এখন মুখ্যত শিল্পসাহিত্য সৃজিত হয়ে চলেছে।

সাধারণ মানুষ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচন করার জন্য যথেষ্ট যোগ্য বলে মনে করে কিন্তু তাদের কর্তাদের নয় সমসাময়িক পুঁজিবাদ গণতন্ত্রকে উদযাপন করে।

ধর্মীয় সমালোচনাগুলিও দেখুন: ধর্মীয় কমিউনিজম, খ্রিষ্টীয় সাম্যবাদ, খ্রিষ্টীয় সমাজতন্ত্র, ইসলামী সমাজতন্ত্র, ইহুদি বাম, লিবারেশন ধর্মশাস্ত্র, এবং সামাজিক গসপেল ক্যাথলিক চার্চ সুদ নিষিদ্ধ ক্যাথলিক সামাজিক শিক্ষার রেরাম নোভরুম এবং কাদ্রজেসিমো অ্যানো অনুসারে, রাজনৈতিক পুঁজিবাদকে [স্পষ্টীকরণের প্রযয়োজন] সমর্থন করে না, মূলত কারণ এটি লিবারালিজমের অংশ এবং দ্বিতীয়ত এর প্রকৃতি দ্বারা, যা সামাজিক ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে যায়। ২০১৩ সালে, পোপ ফ্রান্সিস পুঁজিবাদকে "অত্যাচার" হিসেবে অভিহিত করেন যা মানুষকে ভোগ্যবস্তু করার ক্ষমতা দ্বারা বিশুদ্ধভাবে বিচার করে। পোপ বলেছিলেন যে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার "একনায়কত্ব" এবং "অর্থের মূল্য" মানুষকে দু: খজনক করে তুলছে। ইসলামের স্বার্থে অর্থ, পুঁজিবাদী অর্থের অপারেশন পদ্ধতি, যদিও নিষিদ্ধ ঐতিহ্যগতভাবে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করা লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলি লাভের বিকল্প পদ্ধতিগুলি উদ্ভাবন করেছে। কনসার্ভেটিভ এবং ঐতিহ্যগত সমালোচনাগুলি এই বিভাগটি কোনো উৎস উদ্ধৃত করে না।

" একজন কৃষক যদি মাল খেয়ে রাস্তায় গড়াগড়িও দেয় জানবে তবুও সে তোমার থেকে বড়বিপ্লবী । " চারু মজুমদার(২৬)

প্রকৃত ছোট কাগজের আবেগে এসব প্রতিকূলতার মাঝখান দিয়ে এখনো সৃজনশীল ব্যক্তি-উদ্যোগ তৎপর রয়েছে। বিদ্রোহের, প্রতিবাদের ও গোষ্ঠীচেতনার রূপান্তরের প্রক্রিয়া এখনো চলমান। এ ধরনের প্রক্রিয়া সব সময় খুব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান না-ও থাকতে পারে, অথবা এখন যতটা দৃশ্যমান প্রকৃত সংগ্রাম তার চেয়ে অনেক বেশি; কারণ ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয়।
এক দৃঢ় সংকল্পের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলবে প্রকৃত ছোট কাগজের সে লড়াই। আর প্রতিটি সংগ্রামেরই একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। যেমন যে কোন আন্দোলনের একটি সফলতা বা সংস্কৃতিক বা শিল্প,সাহিত্য ভিত্তিক অন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে আমরা অবগত আছি যে সেগুলো অতীতের প্রচলিত সকল শৃঙ্খল, আগ্রাসন, আধিপত্যবাদীতার সমাজ ও রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারিতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ধারালো তুলি বা ‘কালির গমক’ নিয়ে এগিয়ে এসেছে স্পর্ধার স্ফুলিঙ্গের জ্বলজ্বলে আগুনের সুপরিকল্পিত ও চেতনার স্ফুরিত স্ফুলিঙ্গ।

শার্ল বোদলেয়র-এর কথায়ই বুঝে নিতে পারি যে মুনাফা-পুঁজির নগ্নতাকে আরো নগ্ন করে দিয়ে তিনি মারলেন এক লাথি, এ কথার মধ্য দিয়ে যে,“ জীবিকা উর্পাজন করা যায় না এমন লেখা লেখাটা প্রতিভা। জীবিকা উর্পাজন করা যায় না এমন লেখা লিখতে হবে।”(২৭)

10

ভুল প্রমাণ করি,“ এ দেশের ছেলেরা গোখরো হয়ে জন্মায়, ঢোড়া হয়ে মরে ।" রামকৃষ্ণ এর এই কথাটি ।(২১)

জিরো জেনারেশন জিন্দাবাদ!! প্রকৃত লিটিলম্যাগ বলতে আমরা সেইসব লিটিলম্যাগ কে বুঝি যে সব লিটিলম্যাগ প্রকৃতার্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধী চেতনা শুধু লালন করে না এর বহিঃপ্রকাশ ঘটায় লিটিলম্যাগ বা ছোটকাগজের মৌলিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট সমূহ ধারণ করে।

সুনির্দ্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে কমিটমেন্ট না থাকলে লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট কার্য়কর হয় না। যার লক্ষ্য থাকবে সাহিত্যেও প্রয়োজনে যে নতুনত্ব, সততা ও দ্রোহ এবং নতুন মাত্রার শিল্পসত্তার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করা আবশ্যক তা জিরো জেনারেশন এর আছে।  জিরো জেনারেশন ধ্যান-ধারণা ও শিল্পিসত্তার সততা শিল্প তথা মানুষের জন্যলেখকের দায় প্রকাশ না হলে শিল্প পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে না। আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ সামাজিক দায়বোধ সম্পন্ন আত্ম সচেতন এবং শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব এর প্রতিফলন উত্তর পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাই আমরা শঙ্কামুক্ত !   মৌলিক সহিত্যচর্চার জন্য যে নিষ্ঠা, শ্রম, আবেগ ও যুক্তির বিন্যাস প্রয়োজন তা কেবলই লিটিলম্যাগেই আছে। লিটিলম্যাগ হচ্ছে মৌলিক সহিত্যের সেই অনিবার্য পদ্ধতি, সবচেয়ে বেগবান ও দ্রোহী এক মাধ্যম যা নতুন ধারণাশৈলীর আবিস্কার করে নিজেকে সবচেয়ে গতিশীল মাধ্যম, সুতীব্র সাহসী পদ্ধতি, যা সকল পুরাতন ফরমায়েশী প্রথা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।

বাল-বাজারি মলমূত্রের ধারাবাহিক প্রোডাকশন চলছে-চলবে!!! কাগজ উঠে যায়, যাক!! তবু এই নিম্নমেধার প্রোমোটিং বন্ধ হবে না, কারণ যে অদৃশ্য লোকগুলো ওই অ্যান্টিচেম্বারে বসে আছে, তারা প্রতিভা, মেধা, পোটেনশিয়ালিটিকে যমের মতো ভয় পায়, অতএব তাদেরকেই প্রোমোট করো, যারা জীবনে কোনোদিন একলাইন কবিতা লেখার যোগ্যতা রাখবে না!!! এককলম সত্যিকারের ফিকশন লিখতে শিখবে না!!

না, কোনোটাই আপনি করবেন না, বিগত একদশকে বাংলা কবিতায় এসে গেছে বেশ কিছু নতুন লিটিলম্যাগ, লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট  গতি ধারায় এসেছে লড়াকু প্রকাশক, যারা, সযতেœ এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিদের বই ছাপছেন, একটা বিকল্প পাঠকবৃত্ত অলরেডি তৈরি করে ফেলেছেন তারা, বাল-বাজারি পাবলিশারের চেয়ে তাদের ছাপা কবিতার বইয়ের বিক্রি নিঃসন্দেহে বেশি, এসে গেছে ফেসবুকের মতো অসম্ভব শক্তিশালী কবিতা-মাধ্যম যেখানে একদম সরাসরি লেখক-পাঠকের ইন্টার-অ্যাকশন ঘটছে, বাল-বাজারি মনোপলি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে আর এক দশকের মধ্যেই, হতে বাধ্য, মার্কেটের নিজস্ব লজিকেই তা ঘটবে, ঘটবেই কমরেড, ঘাবড়াবেন না, পিছু হটবেন না, লড়াই জারি রাখুন!!

জিরো জেনারেশন এর লিটিলম্যাগকর্মীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এই  প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা কে তাই লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট কে বহুমুখী ধারনায় এনে দায়বদ্ধতার সাথে নিবীড় সখ্যতা গড়ে তোলে লিটিলম্যাগ এর সাথে। নানান পরীক্ষা-নীরিক্ষা, শব্দ, ভাষা, দাড়ি-কমা, বিষয় বস্তু, পাঠকের রুচি, মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছে। নব্য কায়দার পুঁজিবাদের বহুজাতিক পন্থার বিরুদ্ধে সরাসরি তীর্যক উচ্চারণ করে জানান দেয় নিজেদের উপস্থিতি। ফলে শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির পথে কোন পংকিলতা, ক্লেদ, মুনাফাখোরের মামদোবাজি, ভাঙন, বুঁর্জোয়া পরিবেশ কোন কিছুই জিরো জেনারেশন কে বাঁধা দিতে পারবে না কারন এ সময়ের লিটিলম্যাগকর্মীরা সর্বদা প্রস্তুত তাঁরা চায় শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির চুড়ান্ত পরিবেশ, এ ক্ষেত্রে তাঁরা আপোষহীন। কেউ মানুক আর নাই মানুক উপলব্ধীর দুচোখ খোলা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা ও লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট আমাদের মৌলিক দৃঢ় অবস্থান, লিটিলম্যাগ আমাদের সাহসী উচ্চারণ।

লিটল ম্যাগাজিনের বিষয়টি পর্যলোচনা করলে নিমোক্ত বৈশিষ্ট আবিস্কার করি;-

 ১. প্রতিষ্ঠানবিরোধী অরাজনৈতিক প্রথাবিরোধীতার কমিটমেন্ট,
২.  পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী প্রবনতা,
৩.  ধৈর্য ও আস্থাশীলতা,
৪.  বিষয় ও ভাষার বৈচিত্র,
৫.  প্রচার, পদক, খ্যাতি, অর্থ, ফরমায়েশী সাহিত্য বিমুখতা,
৬.  প্রচলিত বাজার ব্যবস্থায় গা ভাসিয়ে না দেওয়া,
১০. পুঁজীবাদের  পতনের সম্ভাবনায় বিশ্বাসী,
১১. পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা,
১২. স্বতন্ত্র মতপ্রকাশক,
১৩. ধর্ম, গোত্র, জাতীয় মূল্যবোধের চেতনায় আঘাত না করা,
১৪. সাবলীল, সরল, সাধারন মানুষের ভাষার ব্যবহার,
১৫. সাহিত্যচর্চায় চরমপন্থার ব্যবহার,
১৬. নতুন কিছু আবিস্কার এর নেশা।

বর্তমান সাহিত্যে যত নতুন পথ ও মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে তার সবটুকু এসেছে লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট এর অর্জন হিসাবে।

লিটিলম্যাগ মানেই নতুন দ্রোহী প্রতিষ্ঠান বিরোধী নিরীক্ষাপ্রবণ প্রতিভাবান নতুন লেখকের আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ ঘটবে তাতে। তাদের ভঙ্গিটিও থাকবে আক্রমণাত্মক, প্রচলিত রীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চাইবেন। একধরনের অহং ও প্রচ- দ্রোহই হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিনের লেখকদের বৈশিষ্ট্য। তবে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই লেখকদের রচনার দ্বারাই প্রভাবিত হবে সমকালীন সাহিত্য। তারাই গড়ে তুলবেন নতুন সাহিত্যরীতি Ñ ভাবনা ও শৈলী উভয় দিক থেকেই। শক্তিশালী লেখকের রচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যত গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করাই হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশের সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা।

অত্যাধুনিক কালে সৃষ্টিশীল ভাষার চেহারা পাল্টে যাচ্ছে পশ্চিমী তত্ত্বের চাপে যত না তার চাইতে বেশি অকারণ জোর খাটানোর কারণে। এর নানা বয়ান, নানা ধরন! আমরা চাই না মাটি ছেড়ে কেবল আকাশে উড়ি কিংবা অকারণে মাটিতে গড়াগড়ি খাই। চাই মাটি আর আকাশের মধ্যে রঙধনুর বন্ধন ঘটুক, একটু যাওয়া-আসার পথ থাকুক।

যারা আমাদের সঙ্গে এসেই চলে গেলেন একটি বাতি জ্বালাই তাদের পথে। চিহ্নিত শত্রু ঘৃণ্য, তার চাইতেও বেশি ঘৃণ্য ছদ্মবেশী শত্রু।  ও’রা চাকু চালায় গোপনে, অন্ধকারে কাপুরূষের মতো।
তাই সব ডিসকোর্স, ডিসঅর্ডার, বুঁর্জোয়া পুঁজির কাছে নতজানু ফরমায়েশী সাহিত্যের পতিতা ও ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য আমাদের বার্তা, “আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াবার সুযোগ এবং সাহস থেকে সরে পড়–ন”।  জিরো জেনারেশন এর লিটিলম্যাগকর্মীরা লিটিলম্যাগ মুভমেন্ট কে এগিয়ে নিতে কারও ধার ধারেনা।

আজ সেই ভিন্ন স্বরকেও মেইনস্ট্রিমের ভিতর নিয়ে এসেই মূলধারাটিকে আক্রমণ করতে হবে, যা জিজেকের ভাষায়: "বিটন অ্যাট দেয়ার ওন গেম", ইউরোকেন্দ্রিক ভাষাকে আত্মস্থ করেই ইউরোকেন্দ্রিক আধিপত্যকে ধ্বংস করাই আজকের দাবি, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য!!
তাই এসো, ভাঙি, আধিপত্যের ফ্রেম গুলোকে চুরমার করি, ধ্বংস করি আধিপত্যের স্থাপত্য, হুলিও কোর্তাসার বলেছিলেন, কে কোথায় আছো, ভাঙো!! আর আমরা ভাঙছি।(২৮)

তথ্যসূত্রঃ
    আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)।
    লিটল ম্যাগাজিন এক প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিষ্ঠান, কামাল মোস্তফা।
    শৈলেশ্বর ঘোষ-এই অংশটি শৈলেশ্বর ঘোষ-এর "উৎসব" কাব্যগ্রন্থের ব্যাক কভারে আছে ।
    টেক্সচুয়াল কালচার থেকে অ্যাকটিভ কালচারে প্রত্যাবর্তন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ইশতেহার বিষয়ে একটি খসড়া আলোচনাসূত্র
    লিটল ম্যাগাজিনের চারিত্র-সন্ধানে, সরকার আশরাফ
    ছোটকাগজ /বড় কাগজ বৈপরীত্য ও সৃষ্টির প্রকাশ, মঈন চৌধুরী
    সংস্কৃতির ভাঙা সেতু ; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রকাশক : নয়া উদ্যোগ, কলকাতা ২০০০,
    সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, প্রবন্ধ : বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে? প্রকাশক: নয়া উদ্যোগ, কলকাতা ২০০০,
    হাংরি জনোরশেন রচনা সংগ্রহ,সম্পাদনা: সব্যসাচী সনে।
    প্রতিশিল্প / সংখ্যা ১ম, নভেম্বর ১৯৯৪, সম্পাদনা: মারুফুল আলম।)
     লিটলম্যাগ/ গুণে বৈগুণ্যে কথা ও কবিতা ২: গেওর্গে আব্বাস
     এই অংশটি - সেলিম মোরশেদ  এর উপন্যাস সাপলুডু খেলা এর ব্যাক কভারে আছে।  প্রতিশিল্প / সংখ্যা ২, নভেম্বর ১৯৯৪
     বাংলাদেশের ছোট কাগজ আন্দোলনের বিচ্ছিন্নতা ও রাজনীতিহীনতা । মঙ্গলধ্বনি:মাহাবুব হাসান
     প্রসঙ্গ লিটলম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং সুবিমল মিশ্র: মারুফুল আলম, প্রকাশক:‘দ্রষ্টব্য’২০১৭
     হাংরি জেনারেশন রচনা সংগ্রহ,সম্পাদনা: সব্যসাচী সেন।
     কল্লোল যুগ: বাংলা আধুনিকতার একটি ঝলক:অপূর্ব জাহাঙ্গীর
     ভাষা বিমোচন, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রকাশক : প্রতিভাস, কলকাতা বইমেলা ২০০৭,
     কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র ১৮৪৮,
     নবারূণ ভট্টাচার্যের অগ্রন্থিত কবিতা, নবারূণ ও বিপ্লব! - রক্তিম ঘোষ
     স্বপ্নের সারসেরা [ছোটকাগজ আন্দোলনের ২৫ বছর] / ২০১০, উলুখড়।।
     শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের বাণী হতে সংগ্রহীত ।
     হুলিও কোর্তাসার : ল্যাটিন আমেরিকার বুমসাহিত্যের পুরোধাহুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-১৯৮৪) এর পবিত্র হিংসা ।
     কিংবদন্তী বিপ্লবী চারু মজুমদার (১৪ মে, ১৯১৫ - ২৮ জুলাই, ১৯৭২) হলেন ভারতের প্রখ্যাত নকশালপন্থী ও মাওবাদী রাজনীতিবিদ।
    ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬২ ) : ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি, সমালোচক ও অনুবাদক।



কোন মন্তব্য নেই