বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিলম্যাগাজিন ব্লগ

সাম্প্রতিক পোষ্ট

কবিতার ভাষা কিংবা নিরাসক্ততার কাব্যফর্মে র বোঝাপড়া│সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ

কবিতার ভাষা কিংবা নিরাসক্ততার কাব্যফর্মে র বোঝাপড়া│সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ
কবিতা বিষয়ক গদ্য

এক.

কবিতাকে কোন ফর্মে লিখতে চাচ্ছি সেটা বড় কথা নয়। কবি যে ভাবে চান সেভাবে কি কবিতাটি কবির নিজস্ব অনুভবের শিহরণে, ভাবাবেগকে, শব্দের দ্যোতনায়, অবাধে শৈল্পিক বিচরন, বিমোচন প্রয়োগে প্রকাশ করতে পারছেন কিনা সেটাই বড় কথা । কবিতা হচ্ছে কি হচ্ছেনা সেটা বিচার এর দায় কবির নয়। আমি বিশ্বাস করি পাঠকই কবিতা পড়ে কবিতা কোন ফর্মে র সেটা আবিস্কার করেন।

কবিতাকে কতোটা ন্যারেটিভ ফর্মে করা যায়, না কবিতাকে কোলাজ ফর্মে করবো, না কবিতাকে স্যুরিয়ালিস্টিক ফর্মে নিয়ে যাবো, না কবিতাকে ম্যাজিক রিয়ালিজম ফর্মে  যাবো? কোন কবিই কি কোন কবিতা শুরুর আগে কোন ফর্মে কবিতাটি লিখবেন, সেটা কি ঠিক করে নিয়ে লেখেন? এছাড়া দ্বন্দীকতা, বাস্তবতা, পরবাস্তবতা, ইচ্ছা, নষ্টালজি,স্বপ্ন আর সম্ভাবনা, আধ্যাত্মিকতা,নিরাসক্ততা সহ বহু রকমের কাব্যফর্মে  অনেকেই লেখেন। যারা লেখেন তাদের কবিতাকে আমি যান্ত্রিক-কৃত্রিম কবিতা বলবো।

এছাড়া গদ্য আর গীতিধর্ম – এই দুই বিপরীতের সমন্বয় সাধিত হয়েছে তিন উপাদানের চৌকস মেলবন্ধনে,

এক. মুক্তক অক্ষরবৃত্তের অসমপার্বিক আবর্তন, পর্ববিন্যাসের স্বাধীনতার কল্যাণে যা প্রায় গদ্যের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে;

দুই. অন্তমিল আর মধ্যমিলের কারুকাজ এবং

তিন. মিষ্টি চলতি শব্দের অনায়াস সংস্থান। যদিও সামগ্রিক গীতিধর্ম কমে গদ্যের বিবৃতিধর্ম ক্রমেই বেড়েছে। তাই বলে কি কবিতা হচ্ছে না।

কবিতা হচ্ছে শব্দশিল্প এর সেই মাধ্যম যা কবির হাত দিয়ে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হয়ে যায় কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। কবিতা হচ্ছে উচ্চক্বীত আহ্বান। তাই কবিতা কোন গন্ডি মানে না। আর কবিতার উচ্চক্বীত আহ্বানের গভীরে আছে এক অচিন-হয়ে-আসা ‘ভাষা’র পুনর্নির্মাণ। বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের যে কোনো মাপকাঠিতে এটা এক রকমের ত্বুরীয় এনতেজাম। কখনো কবি নিজে কোনো অর্থেই তার  কবিতার অংশ  হননা। অর্থাৎ, কবির বলার কথাগুলো তাঁর নিজের কথা নয়, এমনকিও তাঁর শ্রেণিরও নয়। কিন্তু দুটোরই সার্বিক সিদ্ধান্ত কবির কবিতাটিতে আছে। কবিতা বদলে যেতেই পারে কবিতারতো কোথাও কোন বাঁধা নেই।

কবিতা লিখতে গিয়ে কবিতায় জীবন দর্শনের যে প্রধান তিনটি দিক এর মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই ;-

এক. বেঁচে থাকার আনন্দ বা বেঁচে থাকার অনিচ্ছা

দুই. পার্থিব জগতের সীমাবদ্ধ তুচ্ছতার প্রতি সকরুণ ভালোবাসা  বা করুণা এবং

তিন. সেই সঙ্গে অব্যক্ত বিরাটের প্রতি অনুরাগ বা ব্যাক্ততার প্রতি আসক্তি।

আমার কবিতার জীবন দৃষ্টিময়তায় সমৃদ্ধির চিহ্ন, কবিতার ভাব-ভাষা নিয়ে নীরিক্ষা -প্রক্রিয়ায় কবিতায় কিভাবে সেটাকে উম্মোচিত করে এর বেপরোয়া পরিণাম কি হবে হয়তো সেটাই আমার কবিতা জীবনের সৌন্দর্য, স্বপ্ন আর সম্ভাবনা, নীরিক্ষা -প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি। নিজের বৈশিষ্টতা অক্ষুণ্ন রেখেই সংশ্লিষ্ট দশজনের কথা কবিতায় বলতে চাই যেন কথাগুলো নিজেরই কথা। একইভাবে নিজের কথা কবিতায় বলতে চাই যেন  পুরো সমাজের কথা কবিতায় বলছি। এইসব বোঝাপড়ার কাজ ভবিষ্যতের জন্য রাখা থাকবে, যেমন আমরা সকলেই জানি।

কবিতার কি কোনো ধারা আছে?

সব ধারার সমন্বয় করে কি কবিতা লেখা  যায়না?

দেশে যে পরিমাণ কালার-ব্লাইন্ড আছে তারচেয়ে অধিক অ..ধি..ক পরিমাণে কবিতার পাঠকজগতে কল্পনাদৃষ্টিহীন কাব্যবধির আছে। নন-ভিশনারি এবং অকর্ণ এই ধারাকে অনুধাবন করেই সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন— ‘সকলেই পাঠক নহে, কেউ কেউ পাঠক।’ এসব নিঃসাড় বধির পাঠকদের সেবা দিতেই বাংলা কাব্যজগতে ‘ভালোলাগা কবিতা’ এবং ‘ভালো কবিতা’— এই দুই ধারায় কাব্যসাহিত্য প্রবাহিত হচ্ছে।

দুই.
If more politicians knew poetry, and more poets knew politics I am convinced, that the world would be a better place in which to live.”-John F Kennedy

ভিলানিয়াসে তখন সোভিয়েত শাসন। এক কবি তাঁর যৌবনের শহর থেকে পালিয়ে চলে এলেন নাৎসি অধিকৃত ওয়ারশ’তে। সেখানে তখন সমাজতান্ত্রিক প্রতিরোধ চলেছে। কবি হয়ে উঠলেন ওয়ারশ’ প্রতিরোধের একজন। নাৎসি-বিরোধী গোপন কবিতা সংকলন করতেন রাতের অন্ধকারে। কবির নাম চেসোয়াভ মিউশ। আজন্ম প্রতিবাদী এই কবি পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেননি, কিন্তু নিজেকে পোলিশ কবি বলতেন। ‘ডেডিকেশন’ কবিতায় লিখেছিলেন,

‘What is poetry
Which does not save nations nor people?’

ফরাসি প্রতীকীবাদী কবিদের মত তিনি বিশুদ্ধ কবিতার রাজ্যে পালিয়ে যাননি। প্রথাগত নন্দনবোধ ও শিল্পভাবনার বাইরে তিনি তৈরি করলেন প্রতিবাদী দ্বন্দ্বের স্বর।

প্রতিবাদী কবিতা মানেই তাকে রাজনৈতিক হতে হবে এমন কোনও নির্ধারিত হিসেব নেই। প্রতিবাদের উৎস হতে পারে মানুষ। বিশেষ করে নিপীড়িত, প্রতারিত ও শোষিত অবহেলিত যারা। এমন এক কবি ছিলেন ল্যাংস্টন হিউজ। আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেও কালো মানুষদের দাবির কথা বলেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। তাঁর ‘Negro speaks of River’ কবিতাটি পৃথিবীতে আলোড়ন ফেললেও তার প্রতিবাদে ছিল কালো মানুষদের আভিজাত্য, আত্মার গভীরতা ও বর্ণবিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে মূর্ত প্রতিবাদ।

আসলে কবিতা রহস্যময়, সুক্ষ্ম, পরিশীলিত বোধ।

তাইতো কবি আজীজুল হক বলেছেন, ‘কবিতা হচ্ছে উচ্চক্বিত আহ্বান।’

উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক -এ সব মিলিয়ে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আলোকিত এক নিভৃতচারী প্রাণ – যা পাঠককে নিয়ে যায় নতুন ভাবনার ঘেরাটোপে। এখানে তাৎক্ষনিকতা, ফরমাশ পূরণ, বার্তা প্রেরণ, উচ্চকিত কন্ঠস্বর কবি ও কবিতাকে সময়ের দাবি মেটাতে শেখায়। প্রচুর হাততালি জুটে, স্তাবকরা ঘিরে ধরে ভালোলাগার কবিতা হয়; ভালো কবিতা বা কবিতার নির্মাণ থেমে গোলকধাঁধা তৈরী হয়।

প্রকৃত কবিতার পাঠক ল্যাবেনচুষের মতো বিষয়ভিত্তিক শ্লোগানসর্বস্ব স্বাদু কবিতায় নেশাগ্রস্ত হয়ে কবিতার মধ্যে কবিতা না খুঁজে ভালোলাগা খুঁজে বেড়ায়। তাই এটা সন্দেহাতীত যে, মস্তিষ্কে দীর্ঘসময় অস্থিরতার যন্ত্রণাশেষে হৃদয় দিয়ে লেখা কবিতাই কবিতা বা ভালো কবিতা।

প্রকৃত কাব্যবোধের অধিকারীর পক্ষেই সম্ভব “ভালো কবিতা” ও ” ভালোলাগার কবিতা”র  মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে কাব্যশরীরের রূপায়ন। আমরা যারা লিখি, অনুভূত বিষয়টিকে শব্দচিত্রে সাজাই –  আলোচ্য দুটি ধারার কোন্ স্রোতে বৈঠা বাইবো তারই সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তবেই সঠিক ঘাটে তরী ভেড়ানো যায়। আপনার বিশ্লেষণের তাৎপর্য কবিতা রচনাকারদের স্ব স্ব লক্ষ্যে পৌঁছার পথ বেছে নিতে প্রেরণা দেবে নিশ্চয়।

মূলত জীবনের সৌন্দর্য, তার দ্বন্দ্ব ও গতি, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতা, সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি সংগ্রাম ও আত্মসন্ধানের সমন্বিত পরিচর্যায় তাঁর যে কবিতার রহস্যময় জগৎ,  তা অবিশ্বাস্যভাবে মনুষ্যলোকে কখনও কখনও হয়ে ওঠে অলৌকিক,পূর্ণ মাত্রায় নান্দনিক এবং শিল্পের প্রকৃত দর্শন !

‘কবিতার জন্য নিয়তিকে বশে আনতে হয় । অথবা কবিতা মনের বিশৃঙ্খলাকে কয়েদ করে ।’-মলয় রায়চৌধুরী।

পাঠকের ‘কল্পনা’ হচ্ছে কবিতায় যা নেয় বা যা অনুপস্থিত তা পাঠককে কাব্যবোধ দিয়ে সৃজন করা অর্থাৎ কাব্যমিথ্যে সৃষ্টি করা। কাব্যমিথ্যের সৌন্দর্য্যই হচ্ছে একটি ‘ভালো কবিতা’র যাদুদন্ড। এই যাদুর প্রভাবেই পাঠককের ভিতর থেকে কাব্য-জিজ্ঞাসায় সৃজনশীলতা জেগে ওঠে।

কবিতায় বাস্তবধর্মী বর্ণনার চিত্রায়ণকে এখানে ‘চিত্ররূপময়তা’ বলা হয়নি। কাব্যকথনে যা প্রকাশ করা যায় না, সেই অধরাকে বচনাতীত শব্দ দিয়ে আঁকিয়ে কবিতায় সেই ‘চিত্ররূপময়তা’ ফুটিয়ে তুলতে হয়। বচনাতীত বোধকে যখন শব্দ দিয়ে চিত্রিত করে কবি যেভাবে চিত্ররূপময়তা সৃজন করেন, সেরকম সক্রিয়তা থেকে সৃজনশীল পাঠকও কবিতাটি পাঠকালে চিত্ররূপময়তা সৃজন করে থাকেন। চিত্ররূপময় কবিতার পঙক্তি পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর সৃজনী কল্পনাশক্তি দিয়ে।

আবার কিছু কবিতায় সময়ের অবয়ব নেই বলেই আকারহীন অনুভবের কথা বলা হয়েছে। এমন অবয়বহীন কল্পনাকে সৃজন করতে হয় ‘অনুভবচিত্র’ দিয়ে। যা বচনাতীত অনুভূতি গভীর স্তর থেকে স্পন্দিত হয়ে প্রকাশ্যে আনা সম্ভপর হয়েছে, এই পঙক্তিটি হচ্ছে কবিসৃজিত সেই অনুভবচিত্র। অনুভব দিয়ে পাঠকরে বলেই শব্দগুলি অর্থময় হয়ে ছবি হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছেও।

তিন.

‘ভালো কবিতা’ পাঠসমৃদ্ধ পাঠক সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে উদ্ভাবনধর্মী কাব্যবিশ্লেষক । অধিকাংশ আলোচকগণ কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ আলোচনায় রুপায়িত করেন কবি ‘কী বলেছেন’ এমন বিষয়কে পরিগণনা করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনাকে টেনে নিয়ে যান। পাশাপাশি কোন মনীষী, কোন দার্শনিক, কোন ব্যক্তিত্ব কী কী বলেছেন— তাঁদের উক্তি দিয়ে বিবৃত বিস্তৃত করেন। কিন্তু কবি ‘কীভাবে বলেছেন’ সেই নিমার্ণের শিল্পকলা নিয়ে আলোকপাত উপেক্ষিত থাকার ফলে ‘ভালো কবিতা’র যথোচিত এবং সন্তোষজনক কাব্যপাঠক তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না। কাব্যবিশ্লেষণের মূল ফোকাস পয়েন্টে অবশ্যই থাকা দরকার কবিতা ও কবিত্ব।

কবির এই ত্রয়ীর প্রকরণগত রীতি এবং নিমাণশৈলীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চুলচেরা কাব্যিক বিশ্লেষণ। কাব্য-নিমার্ণের শিল্পকলাকে আলোচনায় লঙ্ঘন করার ফলে বাংলা কবিতায় ‘ভালো কবিতা’ বোধ সৃষ্টি হচ্ছে না। কাব্যসাহিত্যে ‘ভালো কবিতা’র প্রয়োজনে পাঠককেও সৃজনশীল এবং কল্পনাপ্রবণ হতে হবে অবশ্যই ।

কবি নির্জনে নিভৃতে থেকে গড়ে তুলবেন তার কাব্যের জগৎ। তার দুটো সত্তা- একটি সবসময় লুকিয়ে পড়তে চায়, আরেকটি সত্তা বেরিয়ে আসতে চায়। এই দুটো সত্তার মধ্যে অনবরত দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। সমস্ত মুখরতা ছেড়ে দিয়ে কবি যখন একা হয়ে যান, তখনই নৈঃশব্দ্য-এর মধ্যে ঢুকে পড়েন। তখনই পালটে যেতে থাকে চিন্তাভাবনার স্তর, পালটে যেতে থাকে তার বোধের জগৎ। ধীরে ধীরে কবি ঢুকে পড়েন এক রহস্যময় জগতে।তখনই তাঁর সাক্ষাৎ হয়ে যায় অপার রহস্যময়ী কবিতার সঙ্গে। কবিকন্ঠ স্বাতন্ত্র্যে সমসাময়িকদের থেকে পৃথক আসনে বসার অধিকার দাবি করে।

কবি প্রথমে তার আমিত্বকে প্রকাশের তাড়না অনুভব করেন, তারপর প্রকৃতিগত ভাবে আসে তুমি, অতঃপর কবির প্রকাশে ভিড় করে মৃত্তিকা মানুষ সমগ্র পৃথিবী। তবে হ্যাঁ, সাধারণত আমি তুমি প্রেম তাড়িত বা দেশাত্মবোধক কবিতায় বেশি উচ্চকিত যা সর্বজনীন বিষয় ভিত্তিক কবিতার সাথে কিঞ্চিত  সাংঘর্ষিক হলেও তা ব্যবহার নৈপুণ্যে কালজয়ী হয়। তার জলন্ত উদহারন কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা।

তুমি আর আমি শব্দে দোষ কোথায়? মাঝে মাঝে তো করতে হয়।প্রয়োগ ও উপস্হাপনাগত কৌশলের মধ্যে শব্দ দুটোর ব্যবহারের যথার্থতা নিহিত। দোষের কিছু নেই।

কবিতায় আমি মানে মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক শব্দ। অনুরূপভাবে বলা যায়, তুমিও প্রতিনিধিত্বমূলক শব্দ। যে শব্দের মাধ্যমে যে কাউকে বোঝানো যায়। কবিতার শিল্পের প্রয়োজনে যেকোনো শব্দই আসতে পারে যা নির্ভর করে প্রয়োগের উপর। শব্দ ব্যবহারেই বোঝা যায় যাবে কে কতটা শব্দেরকামার, সময়ই বলেদেবে কে কতটা ভাল কবি।

চার.

আমরা আমাদের পরিচয় চিহ্নিতকারীদের দ্বারা নিরবচ্ছিন্নভাবে একটি সর্বজনীন মানবিকতা প্রকাশ করতে সক্ষম হিসাবে সাহিত্য এবং কবিতাগুলি নিয়ে ভাবি। তবে একটি শৃঙ্খলা হিসাবে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসও উপনিবেশবাদের সাথে জড়িত। উপনিবেশগুলিতে, এটি পশ্চিমা শক্তির বৌদ্ধিক ও শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্বকে পুনরায় নিশ্চিত করার একটি পদ্ধতি হিসাবে কাজ করেছিল। কবিতা সম্ভবত আমাদের কাছে উপলভ্য এক অন্যতম র‌্যাডিক্যাল ফর্ম। প্রাক্তন উপনিবেশ এবং ডায়াস্পোরার সদস্যরা অতীতের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে তারা যে অনন্য ও জটিল পরিস্থিতি খুঁজে পেয়েছিল তাদের প্রকাশের জন্য এটি ব্যবহার করেছেন। উপনিবেশিক শাসনের অধীনে বসবাসকারী ব্যক্তিদের জন্য সাহিত্যও ছিল বিদ্রোহের একধরনের। ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি প্রকাশ করার এবং তাদের উপর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা মোকাবেলার একটি উপায়। এর মতো কবিতা আমাদের বিভিন্ন উপায়ে উপনিবেশবাদের পরিণতি বুঝতে সহায়তা করে। উপনিবেশবাদের মানসিক পরিণতি বুঝতে আমরা সম্ভবত সাহিত্যের কাছাকাছি যেতে পারি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ঐতিহাসিক অত্যাচার তাদের নিজস্ব গল্পগুলির মধ্যে ঘটেছিল । আবিষ্কার ও আধিপত্যবাদের বিবরণ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম করে এবং উজ্জ্বল করে  কীভাবে উপনিবেশবাদ অস্তিত্বশীলতা কেমন ছিল, কবিতা সর্বদা তার প্রতিরোধ ও বিনাশ করে। কাব্যসাহিত্য ব্যবহার করা হোক না কেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যা ঘটছে তাতে মনোযোগী হওয়া এবং সংহতি প্রদানের দূর থেকে প্রচার প্রচারকে সমর্থন করা; সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটি মনে রাখা দরকার তা হ’ল ডিক্লোনাইজেশন কোনও স্থির নীতি নয় বা কেবল একটি বাক্যাংশকে ঘুরিয়ে দেওয়া নয়, এটি গুরুতর চিন্তাভাবনা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দাবি করে।

এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামাজ্রবাদী পুঁজির সংস্কৃতির কাল চলছে, এর কালো থাবা থেকে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, সমাজ এবং অর্থনীতিও মুক্ত নয়। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত জ্বি হুজুরের উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে আত্ম উন্মোচনের যে লড়াইয়ের পথটা এদেশের কবি সাহিত্যের লোকজন নির্মাণ করেছিলেন তা একটি স্বাধীন জাতিসত্ত্বা নির্মিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এক্ষেত্রে এরা নিতান্ত জনপ্রিয়তা কিংবা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য সৃজনশীলতার এসব কর্মযজ্ঞে নিজেদের নিয়োজিত করেননি। এমনকি দীর্ঘ সামরিক অন্ধকারেও দেখা গেছে, সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে কবিতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঐক্যবদ্ধ স্বরায়নে।

কিন্তু আজ সেই বহুবচনের ঐকান্তিক স্বরের প্রতিনিধিরা কোণঠাসা। সামাজ্রবাদী পুঁজির সংস্কৃতি মধ্যদিয়ে এখানে সৃষ্টি হয়েছে একটি মধ্যসত্বভোগী শ্রেণি। এদেরই প্রতিনিধিরা আবার নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া। মিডিয়ার সেই হাতছানিতে সাহিত্যে জন্ম নেয় পরজীবি তথাকথিত জনপ্রিয় কবি লেখকগণ এর বিপরীতে এক শ্রেণীর কবিগণ। যারা বিশেষায়িত শ্রেণির মেজাজের হয়েও শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখান তাদের পাঠকদের।  যাদের নেই সর্বক্ষেত্রে আজ্ঞাবহ গোলামী মনোবৃত্তির লেখক এবং পাঠক। এভাবেই আজ লেখালেখির একটি পরিবেশ তৈরি  হয়েছে বাংলাদেশে। কেননা, এটা না ঘটলে সব নষ্টদের অধিকারে যাবার আগে নিজেরা অন্তত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়ানোর অল্প হলেও একঠুকরো ভূমি পাবে। 

পাচ.

 ‘আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি
যেখানে মানুষ মানুষকে ঘৃণা করে না
-আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি:’ ল্যাংস্টন হিউজ।

প্রতিবাদী কবিতার ইতিহাস কালো কবিদের (ব্ল্যাক পোয়েটস) কলমের রক্তে মিশে আছে। এক নিগ্রো ক্রীতদাসী ছিলেন। ফিলিস হুইটলি। হঠাৎ করেই কাব্যগ্রন্থ লেখেন। ‘Poems on various subjects, religious and moral’. হইচই পড়ে যায়। এই কবিতার বই যেন তাঁর দাসত্বের প্রতিবাদ। বইটি লিখে দাসত্বের জোয়াল থেকে মুক্তি পান হুইটলি।

এক-আধটা ছোট ছোট প্রতিবাদে দু’একটা এমন কাণ্ড ঘটেই থাকে। কিন্তু তাতে সামাজিক নীতির কোনও পরিবর্তন হয় না। তাছাড়া লেখাপড়া জানা চাকর-ক্রীতদাস নিয়ে বড়লোক প্রভুদের অসুবিধেই হচ্ছিল। কাজেই আশ্চর্য আইনে বন্ধ হয়ে গেল কালো মানুষদের লেখাপড়া। অতএব বন্ধ হল কবিতার বই ছাপা। এখানে কবিতা মানেই প্রতিবাদ। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখা হত কবিতা। ছাপা বন্ধ তাই, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত অলিতে গলিতে বাজারে কারখানায় আড্ডায়। আজন্ম ক্রীতদাস কবি ফ্রেডরিক ডগলাস জানালেন প্রথম প্রতিবাদ। যুদ্ধ করেছিলেন নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য। এই অন্ধকারের সময় কালো কবি লেখকদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান ঘটে। যার পোশাকি নাম ‘হারলেম রেনেসাঁ’। নিউ ইয়র্ক শহরে তৈরি হয় ক্লাব। নাম, ডার্ক টাওয়ার। এইখানে বসে অজস্র প্রতিবাদী কবিতা তৈরির সময় নিগ্রো কবিরা দুঃখ করে বলতেন, সমালোচকরা তাঁদের কবি বলেন না। বলেন, নিগ্রো কবি, ব্ল্যাক পোয়েটস।

অথচো সাদা কবি বা কালো কবির অস্তিত্ব আদৌ কি আছে?

কবিতা, সে যখন প্রতিবাদ হয়ে ওঠে, তখন প্রাচীন লাতিন শব্দ ‘niger’ (কালো) আর স্প্যানিশ পোর্তুগিজ শব্দ ‘Negro’ নামে নিরপরাধ শব্দটি আমেরিকাতে জন্ম দেয় পল লরেন্স ডানবার, ক্লড ম্যাককে, জোসেফ সাইমন পটার, মেলভিন বি টোলসন, ফ্র্যাংক হর্ন এবং আফ্রিকার ডেভিড ডিওপ, কালুঙ্গানো, ডেনিস ব্রুটাস এবং অ্যান্টনিও জ্যাসিন্টোকে।

‘ওই বিরাট খামারটাতে কোনও বৃষ্টি হয় না
আমারই কপালের ঘাম দিয়ে গাছগুলোকে তৃষ্ণা মেটাতে হয়’-অ্যান্টনিও জ্যাসিন্টোকে।

রাজনীতি এবং বিপ্লবের সঙ্গে প্রতিবাদী কবিতা মিশে গিয়েছিল এই বাংলাতেও। শহরে, গ্রামে নতুন আন্দোলনের ঢেউ। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও প্রয়োগের মতবিরোধ। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, টালমাটাল সময়। কাব্যগুণ ছন্দের নৈপুণ্য ভেঙে ক্রোধ প্রতিবাদ দুঃখ নিয়ে জন্ম উল্লাস নিয়ে নিয়ত রচিত হচ্ছে রাশরাশ কবিতার।

কবিতায় বাস্তবধর্মী বর্ণনার চিত্রায়ণকে এখানে ‘চিত্ররূপময়তা’ বলা হয়নি। কাব্যকথনে যা প্রকাশ করা যায় না, সেই অধরাকে বচনাতীত শব্দ দিয়ে আঁকিয়ে কবিতায় সেই ‘চিত্ররূপময়তা’ ফুটে ওঠে কবিতায়, বচনাতীত বোধকে যখন শব্দ দিয়ে চিত্রিত করে কবি যেভাবে চিত্ররূপময়তা সৃজন করেন, সেরকম সক্রিয়তা থেকে সৃজনশীল পাঠকও কবিতাটি পাঠকালে চিত্ররূপময়তা সৃজন করে থাকেন। চিত্ররূপময় কবিতার পঙক্তি পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর সৃজনী কল্পনাশক্তি ।

এখনআমাদের  সাহিত্যের ক্ষেত্রে ডিক্লোনাইজেশনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আধিপত্যের ইতিহাসকে স্যানিটাইজিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য আমাদের সর্বজনীন স্থানগুলিকে সাজানো আইকনোগ্রাফি এবং ফলকগুলি বাতিল করে আধিপত্যেকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কবিতার ভাব, ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, চিত্রকল্প, ইঙ্গিতময়তা, কাব্যফর্ম পরিবর্তিত হচ্ছে।

পাঠক ও সময়ের উপর নির্মাণ হয় কবিতার রকমফের, ইঙ্গিতময়তা বুঝিয়ে দেয় মৌলিকত্ব।এখানে ‘কালের’ অর্থাৎ সময়ের অবয়ব নেই বলেই আকারহীন অনুভবের কথা বলা হয়েছে। এমন অবয়বহীন কল্পনাকে সৃজন করতে হয় ‘অনুভবচিত্র’ দিয়ে।বচনাতীত অনুভূতি গভীর স্তর থেকে স্পন্দিত হয়ে প্রকাশ্যে আনা সম্ভবপর হয়েছে, এই অনুভূতির পঙক্তিটি হচ্ছে কবিসৃজিত সেই অনুভবচিত্র। অনুভব দিয়ে পাঠকরে কাছে শব্দগুলি অর্থময় হয়ে ছবি হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছেও।

তাই কবিতারা সৃষ্টিগতভাবেই কখনও স্পর্শকাতর, কখনও অবিনাশী, কখনও আবেগময়, কখনও প্রতিবাদী, কখনও কামুক, কখনও উচ্চভিলাষী।আরএখন কবিতারা হয়ে উঠেছে সামাজ্রবাদী পুঁজির বিরোধী বিপ্লবের শব্দমালা।কবিতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখা আর জঙ্গলের বন্য পশুদের চিড়িয়াখানায় রাখার মতো।কবিরা সামাজ্রবাদী পুঁজির সংস্কৃতি বিরুদ্ধচারণের মৌলিক ডেডিকেশনে কবিতারা ঝেড়ে ফেলুক শব্দবন্ধ্যা সময়কাল, হয়ে উঠুক স্বাধীন বাস্তবধর্মী নিরাসক্ততার বাঁধভাঙা সূর্যের আলোর মত চকচকে।কে কবি আর কে কবি না, কার কবিতা কালজয়ী তার উত্তর সময়ই বলে দেবে। যশ-খ্যতির মোহে আর যাই হোক কবিতা হয়না, হতে পারে না।

কোন মন্তব্য নেই