বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিলম্যাগাজিন ব্লগ

সাম্প্রতিক পোষ্ট

কবি সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ: আগুনের উপর হাত রেখেই যার কবিতার হাতেখড়ি, কামরুল হুদা পথিক




সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ’র জন্ম ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দে যশোর জেলায়। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আগুনমালার পাঠ” প্রকাশিত হয়। যখন কোনো কবির হাতে ফুল ফল পাখি নারী নদী ও হঠাত প্রেমের হাতছানিতে কবিতার গায় গতর বানাতে নিমগ্ন থাকার কথা তখন কবি তৌফিক উল্লাহ’র শানানো চোখের নিশানা ভুল করেনি সমাজ রাষ্ট্র পররাষ্ট্র নীতি-রীতি'র উলঙ্গ উর্ত পরখ করতে! তিনি থমকে গেছেন, বিস্মিত হবার বাহানায় প্রতিদিন চমকে উঠেছেন! আর শিরায়-শিরায় পূর্ব-পুরুষের সংগ্রাম ও চেতনার দ্রোহ নিয়ে অতঃপর কবি অপেক্ষায় দিন গুণে শুরু করেছেন ‘আগুণমালার পাঠের বয়ান। তার সময়কার আরেক প্রথাবিরোধী কবি প্রয়াত সঞ্চয় প্রথমকে উৎসর্গ করা এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে প্রতিশিল্প লিটলম্যাগাজিন, যা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার রাখে।
‘আগুনমালার পাঠ’ যেনো আগুনের উপর দাঁড়িয়েই পাঠ করতে কবি আহবান করেন কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই পাঠককে ঠিক এমনিভাবে “ভালোবাসার শিরায় শিরায় বিষ/ ভাগ্য রেখায় একতা রেখা বাড়িয়ে শুধু নিস।’ কবি যেনো তার কাব্যগ্রন্থের মলাট উল্টানোর পরই বালি সিমেন্ট দিয়ে সেটে দিয়েছেন তার এপিটাফ আর অসম্ভব দৃঢ়তার সাথে এঁকেছেন একের পর এক কবিতা আমাদের বর্তমান বিশ্বময় রাষ্ট্রীয় বিরাষ্ট্রীয় উলঙ্গ উর্ত নীতি-অনীতির চাক্ষুষ পরিভ্রমণের চিত্রকলায় পূর্ণ করে। সকল প্রকার রস, আস্বাদন, মুখশ্রী, ফুলফল কিংবা তরতাজা শারীরীক দেহকলার বিপনীকে প্রত্যাখ্যান করে নির্মাণ করেছেন- রাজনীতি,সত্য সবসময় শুভংকরের ফাঁকি, ও কাঙাল ও নদী, আমরা, লুটেরা, সমীকরণ, কাপালিক, আগুনমালার পাঠ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। 

কবি সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ তার সেই তেজোদ্বীপ্ত তারুন্যের চেতনায় লালন করা বিষয় নির্মাণে তার উপযোগী বিষয়, শব্দ, উপমা ও চিত্রকল্প প্রয়োগে সচেষ্ট ছিলেন শতভাগ। সে কারণেই আগুনমালার পাঠ হয়ে উঠেছে এক ভিন্ন মাত্রার কাব্য গ্রন্থ। যে কেউই এই গ্রন্থ পরতে এসে হোচট খেতে পারে তার সাথে টেস্ট না মেলার কারণে। তবে আমার বিশ্বাস মৌলিক পাঠকের কাছে এ গ্রন্থের কবিতাসমূহ পাঠে তাকে পুনর্পাঠের জন্যে তাড়িত করবে এবং পাঠককে বিচলিত করে তুলবে কাব্য চিন্তা ও চিত্রকল্পের দ্যোতনার স্ফুলিঙ্গে। আমি একজন পাঠক হিসেবে পাঠকালীন সেরকমই উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম এবং একইসাথে কবি ও কবিতার সন্নিকট হচ্ছিলাম। আশা করি আপনিও হবেন। আসুন কিছুক্ষণ কবির কবিতার উপর ভ্রমণ করে আসি। 

১। বর্ষাগুলোকে বরফকুচি বানিয়ে মদের গ্লাসে রাখো / (রাজনীতি) 
২। উপত্যকার প্রবেশ পথের দুপাশে দুটো কবর/ চারপাশে ছড়ানো আরো কয়েক হাজার কবর/ আমরা সবে সন্ধ্যেয় প্রবেশপথ মাড়িয়ে/ ঢুকলাম আগুন উপত্যকায় (সত্য সবসময় শুভংকরের ফাঁকি)
৩। স্রোতহীন নদী ভরে ওঠে পোঁড়া মানুষের হাড়ে/ নিঃশ্বাসের অভাবে মৃত প্রায় মাছগুলো খাবি খায়/ থকথকে আঠুলে কাদার দলা, কুৎসিত গন্ধে নদী/ নদীর উপর দিয়ে শকুনের যাতায়াত বেড়ে চলে (ও কাঙাল ও নদী)
৪। অমসৃণ মাটির ঢেলার পাশে বাবলা কাটার ডালে/ গোখরার সদ্য ছাড়া খোলস (শেষ অধ্যায় পূর্বের শেষে)
৫। ব্যক্তিগত কসাইখানায় মানুষের আত্মা, মানুষের মাথা অনবরত/ কুপিয়ে চলে কাটাহাতের কসাই। লোহার হুকে টাঙানো জিহ্বা/ ভাগ করা ঘিলু-মাংস, চোখ, আঙুল চুষে খায় মঞ্চের সভ্য/ মানুষ চামড়ার ঢোল বেজে ওঠে (ভাগ্যগণনা সংখ্যা)
৬। সব সুখ লুটে। সব দুঃখ পুটে/  লুটোপুটি খায় কামারের কয়লায়/ দানবিক মঞ্চে পাপ পুড়ে পাপ হয়!(লুটেরা)
৭। ফুলকি থেকে বেরিয়ে আসে এক ঝলক আগুন। শিহরণে/ দলিত রোমকূপ ভীষণ; ঘাসফড়িং-লেজে ফুল ও কাঁটাদের/  পথ। সম্ভাবনাময় মেয়েটি থেমে থাকে ভিজে -আগুন দ'লে (আগুনমালার পাঠ) 

আগুনমালার পাঠ-এর ভ্রমোণ খুব মসৃণ নয়, খুব আনন্দ ভ্রমণ নয়, খুব প্রশান্তিদায়কও নয়। কারণ কবি যে সময়কে, যে পর্যবেক্ষণকে যে চেতনায় ধরার চেষ্টা করেছেম্ন, সে পথই মসৃণ নয়। সে পথ দ্রোহের, সে পথ কর্দমাক্ত, সে পথ রক্তাক্তও।  কবি চেয়েছেনও সেটাই, অত্যন্ত সচেতনভাবেই, আগুনমালা পাঠ -এর প্রতিটা শব্দ পয়ার পঙক্তি চিত্র প্রতিচিত্র সবই যেনো পাঠককে টেনে নামিয়ে আনে আরাম আয়েশের সোফা কুশন থেকে কবির যন্ত্রণার কাদামাটিতে।
কবি সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ’র আগুনমালা পাঠ এর পর আরও দুটো কাব্যগ্রন্ত্রহ বের হয়েছে, যেখানেও কবি তার  বিচরণক্ষেত্র অনেকাংশেই একইরূপ পরিলক্ষিত হয়। আমি বিশ্বাস ও আশা করি কবির হাতে আগামিতে নির্মাণ হবে কোনো এক এপিক ধর্মী কাব্য বলয়, যার ভেতর শুধু কবি নিজেই ঘোরে থাকবেন না, অন্যান্যরাও তার ঘোরে অবগাহন করবেন সমুদ্রতল থেকে নুড়ি পাথরের কণা সংগ্রহের। যেমনি আমরা অনেকাংশেই আমাদের প্রয়াত দুই ক্ষণজন্মা কবি শামীম কবীর ও সঞ্চয় প্রথম এর কাব্য শৈলীর ঘোর এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি, পারার চেষ্টাই বা কেনো? ওরা থাকুক আমাদের অন্তরের কোনো বিষুবীয় অঞ্চলে তারকাপঞ্জির মধ্যে হয়তো মিটমিট করে জ্বলে থাকা কোনো না কোনো নক্ষত্রে নক্ষত্রে। 
আমি কবি সৈয়দ তৈফিক উল্লাহ’র কবিতার সেরূপ জগত প্রত্যাশা করছি, অজানা ভ্রমণের এক অনির্দিষ্ট পথ থেকে পথে...





কোন মন্তব্য নেই