বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিলম্যাগাজিন ব্লগ

সাম্প্রতিক পোষ্ট

ছোটকাগজ প্রক্রিয়াজাতকরণঃ বিরোধীতায় নিজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেদেবার পথ ও পদ্ধতি কিংবা হাতিঘোড়া গেল তল, গাঁধা বলে মাইরি কত জল...



ছোটকাগজ প্রক্রিয়াজাতকরণঃ 
বিরোধীতায় নিজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেদেবার পথ ও পদ্ধতি কিংবা হাতিঘোড়া গেল তল, গাঁধা বলে মাইরি কত জল...  
সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ


তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের মেধাবিক্রিত প্রাতিষ্ঠানিক মোড়কে বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদী সাহিত্যের সামাজীকরণ প্রক্রিয়ায় দশকীয় সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে মাতামাতিসহ ভিনদেশী লেখক ভাড়া করে নিয়ে এসে লুঙ্গিড্যান্স করছে সাথেসাথে পুঁজিবাদের অগ্রজ বরপুত্রদের পুরূস্কার নামক তিরস্কার আবৃত করছে আর মনেপ্রাণে ভাবছে তাদের এ সকল প্রাতিষ্ঠানিক তেলেসমতি কারবার এর কারনে তাদের সাহিত্যকর্ম স্বীকৃত হচ্ছে এবং আমাদের সাহিত্যচর্চ্চা সমৃদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ব্রেণওয়াশ প্রক্রিয়ার শিকার করেও মুনাফা লোভীরা ক্ষ্যান্ত নন, প্রয়োজনে শিশু-কিশোরদের বলির পাঠাও বানিয়ে ছেড়েছে। অথচও কার্যকরী কোন প্রতিবাদ নেই।

আদৌ কি তাই ঘটছে?

কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখলেই যেমন সে চক্ষুষ্মান হয় না তেমনি ছোটকাগজ নাম নিলেই সে ছোটকাগজ হয় না, শতবর্ষ পরেও হয় না।

যদিওবা কেউ কেউ সর্বজনীনভাবে বলবেন, মানবতার জন্য সমসাময়িক উচ্চতর পাঠক্রমের একটি বৃহত্তর ভূমিকা প্রদানের বিরোধিতা করে বিতর্কের মধ্যে রয়েছে ছোটকাগজের মুভমেন্ট। তাদের বোধদয়ের জন্য বলা আবশ্যক এটি একটি চেতনার চরম বিকল্প; মানবিক চিন্তাবীদদের প্রশিক্ষণের জন্য নয়, সাহিত্যকে, লেখককে তার নায্য স্বাধীনতা প্রদানের জন্যই ছোটকাগজের মুভমেন্ট। যা তলে তলে বদলে দেয় মতাদর্শিক সহযোগীদের, বেশিরভাগ সময়েই তা থাকে জনগণের চোখের আড়ালে, তারপর হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়, বিস্ময়ে বিহŸল হয়ে পড়ে সবাই। শিল্প, ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম-মানব সংস্কৃতির অধ্যায়নে গভীরভাবে এবং আবেগপূর্ণভাবে জড়িত হওয়ার জন্য, তাদের প্রতিরোধ এবং গ্রহণের আহŸান প্রক্রিয়ারত প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজের মুভমেন্ট।

একজোড়া তাজা চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখার ক্ষমতা পাঠককে তাদের নিজের জীবনকে প্রতিফলিত করতে উদ্বুদ্ধ করে উসকে দেয় ছোটকাগজগুলো। পাঠকের সাথে ছোটকাগজ এর প্রাসঙ্গিক এমন কোন নান্দনিক উপাদান চোখে পড়তে পারে যেগুলি তাদের নৈতিকতা শেখাতে পারে এবং তাদেরকে সুবিচারের অনুশীলন করতে উৎসাহিত করে। আমরা ছোট বেলা থেকে সাধারনত পাবলিক স্কুল সিস্টেমের মাধ্যমে সাহিত্যের একরকম ধারনা পাই, যেখানে যে বইগুলিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেগুলির গল্পের পিছনে নৈতিক-শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকে। যেখানে প্রত্যেককেই বোঝানো হয় মানব প্রকৃতির প্রতিচ্ছবির ভাল এবং খারাপ উভয়ই। এছাড়া সাহিত্যে ও সংস্কৃতি মুলত একটি নির্দিষ্ট ‘জীবনযাপন’ অবস্থাকে বোঝায়, এতে ধর্ম, বর্ণ এবং জাতীয়তা জড়িত থাকে, পাশাপাশি খাবার, পোশাকের কোড এবং আচারের মতো জিনিসগুলিও জড়িত থাকে। তদুপরি, সংস্কৃতি, শিল্প, সংগীত, লেখার এবং সাহিত্যের সাথেই সেগুলো সম্পর্কিতই হয়। সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, যা একইভাবে সামাজিক, ঐতিহাসিক ও আদর্শিক প্রসঙ্গে জড়িত, লেখক তার সাহিত্যচর্চ্চায় সংস্কৃতির কোনও দিক বা দুটি সংস্কৃতির সংঘর্ষের বিষয়ে মন্তব্য করার চেষ্টা করছেন কিনা তা লক্ষ্য করা বিশেষভাবে গুরূত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, এটি পরিস্থিতিগুলির আরও ভাল মতামতকে  উৎসাহিত করতে পারে, তাই পাঠক ছোটকাগজগুলোতে সবসময় সেই একই পরিস্থিতিতে খুঁজে পাচ্ছেন না সম্ভবত কল্পকাহিনীর মতো। সাহিত্যে কেবল জীবনের প্রতিচ্ছবিই প্রমাণিত হয় না, সাহিত্যচর্চ্চার আরও ব্যাপকতার বিষয় খুজে পাওয়া যায়, যা থেকে পাঠককে প্রকৃত সাহিত্য অনুসরণ ও অনুশীলন এবং ফরমায়েমী বাজারী সাহিত্যের পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য ছোটকাগজগুলো নির্ণায়ক হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
পৃথিবী আজ চির-পরিবর্তিত। যাপিত জীবন ক্রমশ এত বিশৃঙ্খলা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি। সাহিত্যের পূর্বের জীবনটি ব্যবহারিক এবং অনুমানযোগ্য ছিল, তবে বর্তমানে ছোটকাগজ সাহিত্য কে মানুষের মন এবং তাদের চারপাশের বিশ্বের উপলব্ধি এবং কৌতূহলের প্রবেশদ্বার হিসাবে বহু মানুষের মনে বিস্তৃত হয়েছে। সাহিত্যের তাৎপর্য ব্যাপকতা লাভ করেছে। ছোটকাগজ মানুষের সম্পর্ককে সংযুক্ত করার এবং কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল তা সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা সরবরাহ করার কারণে এটি অধ্যয়ন করা জরুরী হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায় ছোটকাগজ এর শব্দগুলি আগের চেয়ে বেশি জীবিত, শক্তিীশালী।
আমরা যখন বিশ্বায়ন এবং বিনোদনের ফর্মগুলির কথা চিন্তা করি, তখনই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন‘শো গুলির কথা চিন্তা করি। তবে জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিপরীতে, সাহিত্যের বিনোদন মিডিয়া যে আমাদের বিশ্বব্যাপী বিশ্বের জনসাধারণের গ্রাসের শিরাগুলির মধ্য দিয়ে চলছে তার প্রবাহেও একটি গুরূত্বপূর্ণ স্থান ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী তথা ছোটকাগজের মুভমেন্ট । প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যা অংশীদারিত্ব তথ্যের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সংযুক্ত করছে তারা জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক সীমানা জুড়ে প্রকৃত সাহিত্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে ছোটকাগজগুলো।
সাহিত্য সমাজে ছোটকাগজ মুভমেন্ট এত গুরুত্বপূর্ণ যে এটি পাঠ ও পাঠকদের ইতিহাস এবং আমাদের বিশে^র বিভিন্ন সংস্কৃতির সংহতি হয়ে তাদের প্রেমে, দ্রোহে, চীন্তায়, ন্যায়বিচারের মত ধারণাগুলির দিকে উন্মুক্ত করে,উন্মোচিত করে আদম্য চেতনার সেই জগৎকে।
“সব লেখকের জন্মগত অধিকার ভাষার সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা,
যতভাবে ভাবা যায়। এই বিষয়টি ছাড়া নতুন কোনোকিছু জন্মাতে পারে না।”
                                                            -হারূকি মুরাকামির(১)

ছোটকাগজের প্রত্যেককে অবশ্যই তার নিমগ্নতা, নৈতিকতার ধারাবাহিকতা ত্বরান্বিত করার জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে। সুনির্দ্দিষ্ট না হয়ে সার্বজনীন হয়ে উঠতে প্রতিনিয়ত নিজেদের কে নিজেদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে নিজেদের কে নিরীক্ষা করে নতুন নতুন ধ্যান-ধারনার আবিস্কার এর খেলায় নিয়োজিত করে আজকের এই ফরমায়েশী সাহিত্যের বিকৃত, কপট উদার ভাবটিকে পুরোপুরি চিনতে না পারলে বুঝতে না পারলে এবং কিভাবে সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী সুপারইগোর সম্পূরক ভূমিকা রাখে এর প্রকৃত গতিবিধি আমরা ধরতে পারব না। ফলে ছোটকাগজের মুভমেন্ট নব্যতা দরকার আর সেটা রয়েছে তরূণদের ভিতরে। এজন্যই ছোটকাগজের সম্পাদকরা নিয়মিত কিছু নির্দ্দিষ্ট লেখকদের নিয়ে সংখ্যা করার চেয়ে নতুন সেই সব তরূণদের ভিতরে ছোটকাগজের চেতনা উসকে দেন, উৎসাহিত করেন, তাদের লেখাকে প্রাধান্য দেন। 
ছোটকাগজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ছোটকাগজ নিজস্ব অতীত বা বর্তমান সংস্কৃতিগুলিতে অনন্য অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চলা এবং যার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করছে। তারা লেখকদের স্বাধীন চীন্তাশৈলীর বিকাশ ঘটিয়ে পাঠকদের দিগন্তকে প্রসারিত করতে সহায়তা করছে পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য অংশের সংস্কৃতিগুলি কীভাবে তাদের থেকে পৃথক হয় সেই অবস্থার অবলোকন করে ছোটকাগজের নিজস্বতার রীতিনীতি দিয়ে এই শব্দশিল্প কে বেগবান করে চলে। শিল্প শব্দটা হল আর্ট শব্দের বাংলা, যদিও কনসেপ্টটি এসেছে সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে চেপে। কিন্তু শব্দশিল্প কনসেপ্টটি এসেছে খাঁটি বাঙলা ছোটকাগজ হতে।
প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজের মুভমেন্ট ঘোষনা দিচ্ছে যে আশি, নব্বই দশকের তরূনদের হাতে বাংলা কবিতার, গদ্যের ভাষা ও বিষয়ের বড় ধরনের দিক বদল ঘটেছে, একই রচনাতে কবিতার, গদ্যে ভাষার রীতি ক্রমশ দুরূহতা থেকে যোগাযোগ প্রবন হবার ধাপগুলোর সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিয়েছে। মেনিফেস্টোতে সামগ্রিক সাহিত্য ও সামাজিক অবস্থার সাইকাডেলিক হালচাল, নির্দেশনার সাথে সময় মিলিয়ে বোঝা যায় সম্পাদকিও এবং ছোটকাগজের মুভমেন্ট ম্যানিফেস্টোতে পারস্পরিকভাবে উঠে এসেছিলো নাগরিক অভিজ্ঞতাজারিত মানষিক ও পাঠ প্রস্তুতির আনঅর্থোডক্স সারাৎসার। যে সারাৎসায়নে সাজানো, নিশ্চিত বাগান, বাসাবাড়ির পাশে আগোছালো রাস্তার অনিশ্চিত যাপন, বস্তির বিনোদন, মাস্তিকে আলাদা না রেখে একটা কস্মোপলিটান আদিবাসের অবকাঠামোগত হৃদস্পন্দন তৈরি করার, ভাব ও ভাষার প্রয়োগিক বিমোচন ও সংশ্লেষণ নিরীক্ষার বহিঃপ্রকাশ এর মাত্রা তীব্রতার তীক্ষ শৈলীর উচ্চক্বিত এক বৈপ্লবিক ক্রমশ চলমান ধ্যান ও ধারনা নিয়ে বুর্জোয়াদের খাচাঁয় পোষা ফরমায়েশী সাহিত্যচর্চ্চাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও রাতারাতি সব বুর্জোয়াদের ফরমায়েশী সাহিত্যচর্চ্চাকে বাতিল ঘোষনা করে দিলে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজের মুভমেন্ট এর কতিপয় কুলাঙ্গার প্রতিষ্ঠানগুলোর চকমকি মুনাফা, যশ, খ্যাতি, পুরূস্কার এর লোভে পড়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে পাশাপাশি ছোটকাগজের মুভমেন্ট এ কালিমা লেপন করছেন ছোটকাগজের তকমাধারী লেবাসপরে মহান সাজা কতিপয় বিশ^াসভঙ্গকারী ব্যক্তি। এরা সকলেই আজ চিহ্নিত নতুন করে নাম বলার প্রয়োজনীত বোধ করছি না। এদের জন্য এই মহান প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজের মুভমেন্ট এর কিচ্ছু আসে যায় না। আবার ছোটকাগজের মুভমেন্ট এর নগন্য বাকবাকুম কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা স্বচেতনভাবে বিভিন্ন মিডিম্যাগ, বাজারী ওয়েব জার্নালে লেখা ছাপে আবার বড় গলায় ছোটকাগজের ঢোল পিটিয়ে মোরগ সাজে যেন বাকিরা মুরগী। সাহিত্যেকে পণ্যেয়ানের জন্য বাজারী পুঁজিবাদ পথভ্রষ্টদেরকে প্রচার, প্রসার, প্রদর্শন ও পুরূস্কার এর সুযোগ করে দেয়। আর নিলর্জ্জ বেহাইয়া ছোটকাগজের লেবাসধারী কতিপয় বিশ^াসভঙ্গকারী ব্যক্তি সেই সুযোগে নিজেদের বেশ্যারমত পুঁজিবাদীদের কাছে বিক্রী করে দেয়, যেন তারা সুযোগ খুজছিল আর ছোটকাগজের তকমা পরে সাধু সেজে অপেক্ষায় ছিল। কবে বেশী দাম পাবে, নীলক্ষেতের মেডেল গলায় ঝোলাবে। সব মুভমেন্টেই বিশ^াসভঙ্গকারী ব্যক্তিরা থাকে তাই বলে ঐসব কুলাঙ্গার জারজদেও জন্য কোন মহৎ মুভমেন্ট বাধাগ্রস্থ না হয়ে বরং কলঙ্কমুক্ত হয়।

যদিও একটি মর্যাদার সমাজের অনড়তা ফরমায়েশী সাহিত্যচর্চ্চার প্রত্যেকেরই রুটিনের অবিস্মরণীয় কর্মক্ষমতা উপভোগ করে এবং প্রচলিত আচরণের ধরণ থেকে কোনও বিচ্যুতি সহ্য করে না, পুঁজিবাদ উদ্ভাবককে উৎসাহ দেয়। লাভ হল প্রথাগত ধরণের পদ্ধতির থেকে সফল বিচরণের পুরষ্কার; ক্ষতি হল যারা দেরিতে অচল পদ্ধতিতে আঁকড়ে থাকেন তাদের শাস্তি বলে বুর্জোয়াদের ভ্রান্ত ধারনা পোষন করেন। বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান গুলো ছোটকাগজের এর লেখকদের প্রথমে তিরস্কার করে এতে কাজ না হলে পুরূস্কৃত করে। বুর্জোয়ারা তাদের নানা রকম প্রতিষ্ঠান ও আইন দ্বারা আমাদের সাহিত্যচর্চ্চাকে প্রতিনিয়ত কুক্ষিগত করে চলছে। এই কর্মকান্ডের অংশ হিসেবেই উঠতি বুর্জোয়ারা সংবাদপত্রের নামে এক ধরনের বুর্জোয়া প্রচারপত্রের জন্ম দিয়ে যায়। আর তার জারজ সন্তানটি সাহিত্য সাময়িকী নামে বেড়ে ওঠে বুর্জোয়াদের খাচাঁয় পোষা ফরমায়েশী লেখকূল দিয়ে। সাহিত্যের প্রকৃত স্বাদ অর্জন থেকে বিরত রেখে সাহিত্য কে পণ্যের স্তরে নামিয়ে এনে মুনাফা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে জনগণকে হাজার বছর ধরে শোষণ করাই যার উদ্দেশ্যে। প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনমতো লেখক-বুদ্ধিজীবী কিনে রাখেন, সময়মতো ব্যবহার ও বিক্রির আশায়। অতি নির্মম-নির্লজ্জভাবে এই রূঢ় বাস্তবাই ওই লেখক-বুদ্ধিজীবীর সামনে হাজির হয়। এই লেখকগণ প্রতিষ্ঠানের খেদমতে নিজেকে সর্বদাই নিয়োজিত রাখেন। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী শিল্প-সাহিত্য সরবরাহ করাই এদের অন্যতম কাজ। এই কর্মকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ এর বিপ্লবী নাম প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজ মুভমেন্ট।

সব ধরণের সাহিত্যের বিস্তৃত বাজারে বিবর্তনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। সাহিত্যে এই শব্দটির বিস্তৃত অর্থে বর্তমানে এমন এক পণ্যে রূপান্তর হয়েছে যা বুর্জোয়াদের কাঙ্খিত লক্ষ্য দ্বারা চাওয়া হয়েছিল। তারা খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন এবং বই পড়েন, তারা স¤প্রচার শোনেন এবং তারা প্রেক্ষাগৃহগুলি পূরণ করেন। লেখক, প্রযোজক এবং অভিনেতারা যারা জনগণের শুভেচ্ছাকে প্রশংসা করেন তারা যথেষ্ট উপার্জন পান। শ্রমের সামাজিক বিভাগের ফ্রেমের মধ্যেই একটি নতুন মহাকুমার বিবর্তন ঘটে, সাহিত্যের প্রজাতি, অর্থাৎ মানুষ লেখার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তাইতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাহস পায় প্রয়োজনমতো লেখক-বুদ্ধিজীবী কিনে রাখতে, সময়মতো ব্যবহার ও বিক্রির আশায়। এই সমস্ত লেখকরা তাদের পরিসেবাগুলি বা তাদের প্রচেষ্টার পণ্যটি বাজারে যেমন বিক্রি করেন ঠিক তেমন অন্যান্য সমস্ত বিশেষজ্ঞ তাদের পরিসেবা বা তাদের পণ্যগুলি বিক্রয় করেন, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বলবর্ধক হারবাল ঔষধ, স্যানেটারী ন্যাপকিন, কনডম, টয়লেট পেপার প্রভৃতি পণ্যসমূহের কথা। এই ধরনের সময় আসবে জেনেই কি শার্ল বোদলেয়র আগাম সতর্ক করে বলেছিলেন,
‘জীবিকা উর্পাজন করা যায় না এমন লেখা লেখাটা প্রতিভা।
জীবিকা উর্পাজন করা যায় না এমন লেখা লিখতে হবে।’- শার্ল বোদলেয়র(২)

সত্য যে, ছোটকাগজ মুভমেন্ট পৃষ্ঠপোষকতার এই ব্যবস্থাটি লেখকদের পূর্ণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। পৃষ্ঠপোষকরা তাদের নিজস্ব দর্শন, স্বাধীনতা এবং নৈতিকতার নিজস্ব মানদন্ড চাপিয়ে দেওয়াার উদ্যোগ নেননি কখনই।

বিশ্বসাহিত্যের অধ্যায়ন বিশ্বব্যাপী অধ্যায়নের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার কারণ এটি বিশ্বব্যাপীকরণ বোঝার জন্য গুরূত্বপূর্ণ এমন অনেক থিমকে ধারণ করে। সংস্কৃতি এবং জাতিগুলির মধ্যে কীভাবে তথ্য ভাগ করা যায় তা বিশ্ব সাহিত্য আমাদের দেখায়। এটি ভাষা ও সীমানাকে অতিক্রম করার সাথে সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলিতে কীভাবে রূপান্তরিত হয় তার অর্ন্তদৃষ্টি সরবরাহ করে। নতুন মিডিয়া প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে সাহিত্য ও অন্যান্য তথ্যের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছোটকাগজ মুভমেন্ট জনসাধারণের জন্য জায়গা তৈরি করে। বিশ্বায়নকে সহজতর করার উপায়গুলি বুঝতে আমাদের সহায়তা করে থাকে।

ছোটকাগজ মুভমেন্ট সাহিত্যের রূপান্তরর নয়, প্রচলিত বুর্জোয়াদের মুনাফামুখী পণ্যায়ন এর বিরূদ্ধে   ভিন্নমত পোষণ এবং বিরোধীতা। যারা লেখক প্রত্যেকে যা অনুমোদন করেন এবং শুনতে চান তা কেবল পুনরাবৃত্তি করে তাদের কোনও গুরূত্ব নেই। ছোটকাগজ যে বিষয়টি একাই গণনা করে তা হল উদ্ভাবক, বিভেদকারী, শোনা যায় না এমন জিনিসগুলির আশ্রয়কারী, যে ব্যক্তি প্রচলিত মানদন্ডকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং পুরানোগুলির জন্য নতুন মূল্যবোধ এবং ধারণাগুলি প্রতিস্থাপনের লক্ষ্য রাখেন। তিনি প্রয়োজন বিরোধী এবং প্রচলিত প্রথাবিরোধী, যৌক্তিকভাবে তাঁরা প্রচুর সমকালীনদের বিরোধিতা করছেন। তিনিই প্রকৃত লেখক, যার বই জনগণের বৃহত্তর অংশ কেনে না। কারন তিনি লেখেন কেবল নিজের তাগিদে, নব্য সৃষ্টির উল্লাসে। তার কাছে বই বিক্রি তুচ্ছ অতি নগন্য ব্যাপার বৈ‘কিছুই নয়। বাজারী সকল লেখকেরা স্বচেতন ভাবেই জানেন যে তাদের এই অহঙ্কারী উপক্রমগুলি কতটা কুটিল! দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের অপরাধগুলি কে তারা ভেবেছিল গোপন ছিল ও রয়েছে এবং তারা একটি অনির্দিষ্ট খ্যাতি উপভোগ করে চলে। তবে বিচারের দিন আসবে। তারা নিজেই নিজেরা এগুলি খোলাসা করবেন এবং তাদের অপকর্ম প্রকাশ করবেন। তখন আর সময় থাকবে না।

 “সফলতা এলে আমি ভয় পাই, কারণ নতুন কিছু করলে সফলতা সঙ্গে সঙ্গে আসে না।
আমি যদি সফলতা পাই তার মানে হল আমি এমন কিছু করছি যা তত নতুন নয়।''- সুবিমল মিশ্র(৩)
                                                                     

ছোটকাগজ মুভমেন্ট এমন এক চলমান প্রক্রিয়া যাকে সমস্ত লোক সম্মানজনক ভাবে দেখে, শুধু নিজেদের ঘরের কতিপয় দু-মুখোরা কেবল ফরমায়েশী সাহিত্যচর্চ্চার জঞ্জাল কর্মের পক্ষ অবলম্বন করে জঘন্য অপরাধ করেছে। কেউ তাকে সন্দেহ করে না ভেবে গদগদ থাকে, কিন্তু সে জানে না যে জানতে বাদ কেউ থাকে না। তবে স্মার্ট স্যুথকে বোকা বানানো যায় না। সাহিত্যেও সিরিয়াস পাঠকুল এই জাতীয় অপবিত্র মুনাফিকদের সম্পর্কে সমস্ত কিছইু জানেন। পাঠকেরা ফরমায়েশী সাহিত্যচর্চ্চার জঞ্জাল কর্মের জন্য দোষী সাবস্ত করে কালগণনায় ঐতিহাসিক ভাবে সে সাহিত্য ও সাহিত্যিক নামের বাজারী পন্যগুলো শুয়োরের ভাগাড়ে নিশ্চীত ছুড়ে ফেলে দেবে। সাফল্যের পেছনে যারা ছোটেন তারাই তো ক্ষমতার মূল্যবোধগুলিকে মানুষের মনে বৈধতা দিয়ে দেন এবং ক্ষমতা তাদের আরো বড়ো সাফল্যের দিকে ছুটতে বলে।

একটি বিষয় উল্ল্যেখ্য যে, অনিন্দ্য / সংখ্যা ৩ / জুলাই-সেপ্টেম্বর / ১৯৮৫ ও গান্ডীব / সংখ্যা ১ / ফেব্রূয়ারি / ১৯৮৭ এ তিন কবির যে ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি আমি পাঠ করেছি। ইশতেহার এর আসল বিষয় ছিল তৎকালীন প্রচলিত কবিতার যে ধারা সেই ধারার বিপরীতে কবিতা লেখার আকাঙ্খা। যদিও এটি নান্দনিক ইশতেহার, পূর্ণভাবে বলা যেতে পারে ওয়ার্ডস ওয়াথ এর প্রেথিস টু লিরিক্যাল ব্যালাডস ও তাঁর বন্ধুর লিটারারী বায়োগ্রাফিয়া যেমন তাঁরা দিয়েছিলেন। যদিও তাঁদের কবিতা বিশ্বাস ভিন্ন ছিল। সেই সূত্র ধরে আমি বড়জোর বলতে পারি ঐ ইশতেহার মেনে সেই ইশতেহারভূক্ত কবিতাকে পরবর্তিতে কয়জন কবি বিষয়টা কে তাদের কবিতায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন বা ইশতেহারভূক্তরাওতো এগিয়ে নিয়ে গেলেন না কেন?

তাই বলা যায় কি গোড়ায় গলদ ছিল নাকি স্টান্টবাজী বা ¯্রফে ইশতেহারটি শুধু লেখার জন্য লিখেছিলেন? নিজেদের জাহির করার জন্য যে, আমরা আলাদা।

আশির দশকে সাহিত্যের নান্দনিক ও উৎকর্ষিত পত্রিকা গান্ডীব। এর সম্পাদক হলেন শ্রদ্ধেয় তপন বড়ুয়া। হাবিব ওয়াহিদ ও আশির দশকে ঐসময়ের লেখকদের নিয়ে ছোটকাগজের গুরূত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু তাঁরাও দায় এড়াতে প্রলাপের মত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছে যে, ঐ সময়ে ছোটকাগজের কোন লিখিত গন্ডি ছিল না বা কেউ ভিন্ন ধারার সাহিত্যিকদের সাথে মিশতে পারবেন না বা সংবাদ পত্রেও পেশাগত কারনে যেতে পারবেন না। তাই নিজেরাই ব্যাখ্যা দেন যে, এটি পাতি বুর্জোয়া ঈর্ষা ছাড়া আর কিছুনা এ কথা হাস্যকর। আমি বলবো এটা তাদের অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছুই না। আর ঐ সময়ে  সাজ্জাদ শরীফ এর কবিতার সাথে ইশতেহার যে পরিমাণ সায্যুর্জ ছিল তাই তার কাছে প্রত্যাশা বেশী ছিল, গান্ডীব সম্পাদক তপন বড়ুয়ার কাছেও ছিল। কিন্তু তারা সে প্রত্যাশা কে এগিয়ে নিয়ে যাননি।

ছোটকাগজের সূচনালগ্নে সাজ্জাদ শরীফ এর ঐ সরে যাওয়ায় ছোটকাগজের বিরোধীরা নিজেদের শক্তিশালী ভাবার সহস পেয়েছিলো। যদিও সেটা অতিক্রম করেছে বর্তমান বাংলাদেশের তরূনদের প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজের মুভমেন্ট। এ ধারায় ভ্রান্তি, স্ববিরোধীতার দায় ওদের অন্তত আমাদের নয়। আর নতুন যে পথ তৈরি হয়েছে সেটা তরূনরাই করেছে। আশির দশকের মহাশয়গণ নিজেদের কেচ্ছা নিয়ে নিজেরাই গলবাজি করছে। তরূনরা দৃঢ়তর ভাবে বলবে তাদের আত্মদ্বন্দের জন্য এই মহান মুভমেন্ট অন্তত তরূনরা পন্ড হতে দেয়নি ভবিষৎএ ও দেবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের বিরূদ্ধে দাড়াতে ভয় পায়, সাফল্যের পেছনে যারা ছোটেন তারাই তো ক্ষমতার মূল্যবোধগুলিকে মানুষের মনে বৈধতা দিয়ে দেন এবং ক্ষমতা তাদের আরো বড়ো সাফল্যের দিকে ছুটতে বলে।
যে কোনও দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের দুটো পথ খোলা থাকে। একটা ট্যকটিকাল লাইন। অপরটি স্ট্র্যাটেজিক লাইন। এই মুহূর্তে ট্যাকটিকাল লাইন হিসেবে বাংলাদেশী যে চেতনার আবেগকে জাগিয়ে তোলার সাথে বুর্জোয়াদের মুনাফামুখী সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্যের পণ্যায়ন বিরোধিতা করা জায়েজ হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ এই ক্ষমতার মূল্যবোধগুলিকে ন্যারেটিভ দিক হতে উগ্র ফ্যাসিবাদ আজ বাংলা সাহিত্যের বুর্জোয়াদের আগ্রাসন কায়েম করতে চাইছে। তাই এটা সময়ের প্রয়োজনে জরূরী হয়ে পড়েছে বাঙালির সাহিত্য- সংস্কৃতি, বাঙালির ঐতিহ্য ও তার গর্ব নিয়ে জোর গলায় কথা বলা এই মুহূর্তে প্রয়োজন।
ছোটকাগজ মুভমেন্ট হল সাহিত্যের একাধিক ভিন্ন ভিন্ন লেখার বিভিন্ন লেখক (সাধারণত একই সময়ের মধ্যে) যারা কোন ভাবে লেখার জন্য অনুরূপ প্রেরণা ভাগ করে নেন সাধারণত এই লেখকগুলি একটি ‘আন্দোলনের’ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয় কারণ কোনও নির্দ্দিষ্ট কিছুর বিষয়ে তাদের সহমত রয়েছ।
এমন কিছু লেখককে গোষ্ঠী হিসাবে বিকশিত করা হয় যারা প্রায়শই আলগাভাবে সম্পর্কিত হয়। আর এই কাজটি কোন রকম যশ, খ্যাতি বা মুনাফার তোয়াক্কা না করেই প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজ মুভমেন্ট দ্বারা বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদের সাহিত্যের বিরূদ্ধে হুংকার দিচ্ছে।
সম্ভবত দুই বছর আগে যখন “লোক” যশোরে লিটলম্যাগ মেলা করলো তখন তো প্রতিশিল্প, জঙশন, দ্রষ্টব্য এর সক্রিয় লেখক, কবি, সম্পাদকগণ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর পথিকৃৎ কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ সহ সবাই বয়কট করলেন। তারপরেও আজো সেই “লোক” সাহিত্যের পুরস্কারের জন্য সেলিম মোরশেদ কে বেছে নিতে হবে? “লোক” প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা তথা ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর কোন ছোটকাগজ নয় সেজন্যইতো ছোটকাগজের সবাই “লোক” যশোরে লিটলম্যাগ মেলা বয়কট করেছিল। তারপরও এই বোধহীন প্রতিবন্ধি সুলভ আচরণ কেন?

এবারের “লোক” সাহিত্যে পুরস্কার ২০১৯ প্রাপ্ত রহমান হেনরী আর কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ কে একই কাতারে ফেলার স্পর্ধা ও সাহস গান্ডুরদল কি করে পায়? কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ বারবার জন্মায় না। পাশাপাশি “লোক” তার ২০ বছর পূর্তি উৎসবে লিটিলম্যাগ সম্মাননা প্রদান করছে প্রতিশিল্প কে আর লিটিলম্যাগ প্রকাশনা ও প্রতিষ্ঠান হিসাবে সম্মাননা প্রদান করছে উলুখড় কে? সত্যিই সেলুকাস। এখন দেখার বিষয় সেলিম মোরশেদ, প্রতিশিল্প ও উলুখড় দাতকেলিয়ে লোক এর অনুকম্পা গ্রহন করবেন না দৃঢ়চিত্তে প্রত্যাখান করবেন। সময়ই কথা বলবে, ইতিহাস এর সমুচিত জবাব দেবে। কারও জন্য কোন কিছু থেমে থাকে না। যদি থাকতো তাহলে নগন্য রাজাকারদের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রিয়মাতৃভুমি স্বাধীন করতে পারতো না। জগৎশেঠ, মীরজাফর যেমন ছিল শেষ বাঙলার নবাবীকালে, ১৯৭১ সালে রাজাকার, আলবদরাও ছিলো এদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারাও ছিলো। উভয়ের ভিন্ন উদ্দ্যেশে এই সহবস্থান নতুন কোন বিষয় না। পুঁজীবাদের নব্য কৌশল হিসাবে গুটিকয় তাদের পোষা লেখক ছোটকাগজ মুভমেন্টে গোপনে ঢুকিয়ে রেখেছিলো কিনা বা এখনও আছে কিনা সেই সংশয় জাগে। তাই ছোটকাগজ মুভমেন্টে আরো সতর্ক হতে হবে।

সুভাষ ঘোষ এজন্যই কি বলেছিলেন,
“ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় তোমার ভূমিকা কী?
তুমি কি গাছেরও খাও,তলারও? শোষণ ও জোয়াল সম্পর্কে তোমার ধারণা কেমন?
তোমার ইগো ক'হাত লম্বা-কেবল আমাকে দ্যাখো-ব্যাপারটা কেমন বোঝো তুমি?
তোমার ও তোমার বাবার বিছানার মধ্যে কতটা ফারাক?
বাবার সঙ্গে ধহু লড়রহঃ ধপপড়ঁহঃ?
কীরকম এটি, তোমার বয়স বাড়ার সঙ্গে, বড় বাজার - তুমি কি লেখার ভেতর লেখক খোঁজো?
পাঠক লেখা নিচ্ছে না-তাহলে কি লেখা ভাঙব? ভাষা ভাঙব, ছাঁচ ভাঙব, নিজেকে ভাঙব,
না পাঠকের হোল চুলকোবো? কেমন ওই বৌদির বাপের বাড়ি? "  - সুভাষ ঘোষ।(৪)

বাঙলা প্রবাদেইতো আছে, ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভালো।”  
আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক এমনটাই নয় কি?
এ এক ভয়ঙ্কর সময়। মিনমিনে কবিতা বা সাহিত্য করবার সময় এখন নয়।

ছোটকাগজ মুভমেন্টে আমাদের কি সবরকম স্বাধীনতা নেই নাকি রয়েছে! শুধু আমাদের '‘আত্মচেতনায়'’ তার প্রয়োগটারই যা অভাব। ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর লেখকরা অনুভব করেন, আমরা স্বাধীন কারণ আমাদের পরাধীনতাকে প্রকাশ করার মত ভাষার প্রয়োগ আমরা শিখে উঠতে পেরেছি। তাই এই আত্মচেতনায় প্রয়োগটার অভাব বলতে যা বোঝায়, আজকে দাঁড়িয়ে, আমাদের সমাজের প্রতিটি প্রধান দ্বন্দকে চিহ্নিত করতে সামাজিক যে পরিভাষা ব্যবহার করে দেখিয়ে দেয়; সন্ত্রাসবাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ, গণতন্ত্র আর স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি। ছোটকাগজ মুভমেন্ট এগুলোকে ভুল পরিভাষা বলে। এই পরিভাষাগুলো আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীকে গুলিয়ে দেয় মূল সমস্যা নিয়ে ভাবানোর বদলে। এখন আমাদের কর্তব্য হলো প্রতিবাদীদের হাতে আত্মচেতনাকে উসকে দেওয়া। আর সেই কাজটি ছোটকাগজের মুভমেন্ট নিয়ত করে যাচ্ছে। একজন কবি,লেখক,উপন্যাসিক, চিত্রকর সর্বপরী একজন পাঠক নিজেকে তার অভিজ্ঞতার শেষ সীমানায় নিয়ে দাঁড়াতে চায়, মানুষের ষড়যন্ত্রময় মুখাবয়ব দেখতে চায়; তাই সে সভ্যতার কাছে অপরাধী। ছোটকাগজের লেখকেরা সেই বিদ্রোহী আবেগ নিয়ে সে আক্রমণকরে বোধে, সত্তায়, চেতনার খোলা ময়দানে। তাই হারাবার কিছু নেই এমন কি মৃত্যুর সময়েও।

‘সাফল্য’ প্রকৃত সহিত্যের কাছে কাম্য নয়। আবার নৈরাজ্য থেকে পলায়নও কাম্য নয়। নৈরাজ্যকে ভালোবেসে অবক্ষয়কে জয় করে জীবন ও সত্যকে সুশৃঙ্খলভাবে বহন করে অন্তর্জগৎ, বহির্জগৎ প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্যময় করে সময় ও ভাষাকে নতুন করে মানুষের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করার অভিপ্রায় জাগানোই ছোটকাগজের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এটা কি সত্য যে আসলে কোনো নতুন শব্দ নেই? আমাদের কাজ হচ্ছে নতুন অর্থ দেয়া এবং একদমই সাধারণ শব্দগুলোকে বিশেষ করে তোলা। এই ভাবনাকে ছোটকাগজ মুভমেন্টের কাছে ভরসাজনক মনে হয়। এর অর্থ বহুদূর প্রসারিত, উর্বর জমিজমা শুধু অপেক্ষা করে আছে তাদেরকে চষবার জন্য।
ছোটকাগজ মুভমেন্ট মানুষকে স্পষ্টবাদী হতে সাহস জোগায়, আত্মোপলব্ধির পথপ্রদর্শক হতে প্রেরণা দেয়, জীবনের অজানা রহস্যময় অধ্যায় চিনতে সাহায্য করে। ছোটকাগজ তাঁর দ্রোহ, প্রতিবাদী চেতনা, দৃঢ়চেতা মনোভাব, আপোসহীন চরিত্র, মনোবীক্ষণ, অন্বেষার আকাক্সক্ষা, জাগ্রত চেতনার সম্প্রসারণ, সত্যপরায়ণ জ্ঞান, ধর্মবোধ, দর্শন, ন্যায়নীতি, শাসনপ্রণালি, মানবতা এইসব যুক্তিহীন জগৎ-এর কাছে প্রশ্ন রেখে জীবনকে জাস্টিফাই করে সাহিত্যে স্বকীয়তায় বিনস্ত কওে শব্দের চাষাবাদ করে প্রান্তিক কৃষকের মত।
ছোটকাগজের সাহিত্যচর্চায় পাঠকদের মানবিক অবস্থা বুঝতে এবং কীভাবে তাদেরকে তারা তৈরি করে তোলে, প্রেম, যুদ্ধ, দ্রোহ বা সারাজীবন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ থিম নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রেও সহায়তা করে। পাঠকরা তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা নিয়ে তাদের নিজস্ব মননের বিশ্বে স্থানান্তরিত করছে, যেখানে তারা বিব্রততামুক্ত এবং অন্যের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মৌল মানবিক অনুভূতি সম্পর্কিত নিজস্ব ধারণা তৈরি ও নিজেদের ভাবনার জগৎ কে আলোকিত করতে পারে। এজন্য ছোটকাগজের পাঠকেরা অত্যন্ত সিরিয়াস। এই পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই ছোটকাগজের সাহিত্যচর্চ্চার পরিক্রমায় ভাব ও ভাষা প্রয়োগে, লেখকদের শব্দ প্রয়োগে, ভাবনার বিমোচনে, প্রথাভাঙার প্রবণতা সর্বদা পরিলক্ষিত হয়। 
প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, শিক্ষা, রাজনীতি, মানবিকতার জটিল সম্পকসমূর্হ, সকল কুসংস্কার ভেঙে সরল সত্যরূপ প্রকাশ করা প্রকৃত ছোটকাগজের চরিত্র ও এর মাধ্যমে ছোটকাগজের লেখদের সার্থকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

পৃথিবীর সকল কবিই আমার মতো অন্ধকার এবং আলোকে ভালোবেসে প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্য বহন করে যায় এবং যাবে। ‘চেতনা দিয়েই অপসভ্যতার বিরূদ্ধে কবির লড়াই এবং এ লড়াইয়ে সে সরাসরি জিততে পারবে না তা সে জানে, পরোক্ষ জয়ের অস্পষ্ট একটা ধারণা তাকে চালিত করে। তার ভাষা প্রয়োগ পদ্ধতি হয় গেরিলাদের মত আকস্মিক, অপত্যাশিত এবং অভ্রান্ত।’
                                                                           -কবির বিশ্বরূপ : শৈলেশ্বর ঘোষ (৫)

সাহিত্যচর্চ্চার পরিক্রমায় ছোটকাগজ মুভমেন্ট সময়ের তাগিদে আজ গুরূত্বপূর্ণ শুধু নয় বলা যায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে এজন্য যে তুলনামূলক ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা তৈরিতে সহায়তা করে। পাঠকরা কোনও বইয়ের পৃষ্ঠাগুলির মধ্যে প্রতীকীকরণ সম্পর্কে আরও শিখতে পারেন এবং এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে লুকানো প্রতিকী অর্থগুলির অর্থবহতার অনূসন্ধান করার দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করছে। তদুপরি, তারা একটি বইয়ের চরিত্র এবং থিমগুলির মধ্যে এবং কীভাবে এটি বাস্তব জীবনে প্রযোজ্য হতে পারে তার মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে পারে। এই নীরিক্ষার আচরণ ও অভ্যেস পাঠকদের তৈরি করে দেয় ছোটকাগজ সমূহ।

যে কোনও নির্দিষ্ট বই লিখেছেন সে লেখকের মনের ভিতরে একবার নজর রেখে পাঠকরা কেন কোনও লেখক কে কোনও নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কল্পনা করেছিলেন এবং লেখেনী হতে সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা আবিস্কার করতে পারে। ছোটকাগজ সমসাময়ীক ও অতীতের সময়ের রাজনীতি এবং সামাজিক অবস্থার দিকে নজর দিতে শেখায় এটি যে গুরূত্বপূর্ণ বিষয়টির সাথে পাঠকের চিন্তাভাবনা লেখকের ভাবনার সাথে সম্পর্কিত করে তুলেছে তা লেখকের কল্পনার এক ঝলক হতে পারে। ছোটকাগজ মুভমেন্ট সাহিত্যচর্চ্চায় পাঠকেরা আমাদের চারপাশের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে কী ও কীভাবে অনুভব করছে তা আমাদের জানতে সহায়তা করে চলেছে।

সাহিত্যের মুক্তসূচনার ও মুক্তসমাপ্তির, বিষয়কেন্দ্রহীন, শিরোনাম দিয়ে বিষয় চিহ্ণিত হয় না, যেমন শব্দের ও ছন্দের যথেচ্ছাচার, লজিকাল সিকোয়েন্স বর্জিত, গুরূচন্ডালি ভাষা, ইন্দ্রিয় পাল্টা-পাল্টি, প্রতীক বর্জিত, ছেঁড়া চিত্রকল্প ইত্যাদি। অথাৎ পাঠবস্তুটি বিবেচ্য, লেখক নন। বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদমুক্ত সাহিত্যচর্চায় বইয়ের বাজারের কাটতি কখনই বিবেচ্য হয়না।

প্রতি বছর কয়েক হাজার ফরমায়েশী লেখা লিখলে আর সেগুলো বই হিসাবে প্রকাশ করলে সাহিত্যের কোন উন্নতি বা প্রগতি কিছুই আশা করা যায় না। আমাদের বর্তমান সময়ে যদি প্রকাশিত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে একটি বইকেও কি দুর্দান্ত বই বা রচনা প্রমাণিত হয়েছে বা করতে পেরেছি। এই ধারণাটি নেওয়া কি ভুল হবে যে, এই পাঠকেরা সবসময় ভাল বইয়ের চেয়ে খারাপ বই পছন্দ করে বা তাদের বৈষম্যের অভাব, অতএব কখনও কখনও এমনকি ভাল বই শোষণ করতেও তারা প্রস্তুত? এর দায় লেখক সমাজ এড়াতে পরেন না।

এটি সত্য যে আজ বাজারে প্রকাশিত বেশিরভাগ কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস এবং নাটকগুলি কেবল আবর্জনায় আবদ্ধ। পাশাপাশি বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদমুক্ত ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর প্রকৃত ছোটকাগজ হাতেগোণা ও তাদের লেখকদের বই সংখ্যায় কম প্রকাশিত হয়। এদের বই বা ছোটকাগজ এর কোন প্রচারণা, ব্যানার, ফেষ্টুন থাকে না। তারপরও বাজারে প্রকাশিত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে সচেতন পাঠকেরা ঠিকই সেগুলো খুজে নেন, এই পাঠকেরা ক্রমশ বাড়ছে সেজন্য ছোটকাগজ প্রকাশনার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক ও যতœবান হতে হবে। নিয়মিত নতুন লেখক, লেখার মানয়োন্নন ঘটাতে হবে। প্রচলিত প্রথার মধ্যে থেকে প্রথা ভাঙতে হবে।

সাহিত্যেচর্চার মতাদর্শ বলতে লেখকের মনোভাব এবং আচরণকে বোঝায় এমন বিশ্বাস ও ধারণার সিস্টেমগুলিকে বোঝায়। এই জাতীয় আদর্শ সামগ্রিকভাবে সমাজ দ্বারা মূল্যবান বা দ্বন্দের ভিত্তি তৈরি করে। মতাদর্শ একটি প্রসঙ্গ যা বিভিন্ন উপায়ে ‘অদৃশ্য’। এটির কারণ আমাদের নিজস্ব, বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ এবং স্বাভাবিক হয়, আমরা আমাদের অনুমান এবং সামাজিক নিয়ম অনুসারে কাজ করি। মতৈক্যতা মতাদর্শের জন্য একটি যৌক্তিক বিষয়। জেনুইন একমত অর্জন করা যায় না, বরং সমাজে আরো শক্তিশালী ব্যক্তিরা (বুঁর্জোয়ারা) তাদের ধারণাগুলি অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে এবং তাদের বক্তব্য গ্রহণ করতে পারে। ঐক্যমত্য সামাজিক আদেশ দিয়ে সংরক্ষণ করা যায়না, এটিতে তখন স্তরবিন্যাস ঘটে যায়, বর্তমানে পুঁজিবাদের বিরূদ্ধে সামাজিক আদেশের একটি হাতিয়ার ছোটকাগজ মুভমেন্ট ।

যাঁরা মার্কসবাদী, গান্ধিবাদী, জাতীয়তাবাদী, কিংবা সরকারী বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন, তাঁদের মনে হয়, এই সমস্যাটি বাঘের ক্ষুধার্থ মুখে পড়তে হয় না। লেখালিখিটা যাঁদের ব্যবসা, তাঁরা তো জানেই কেন লিখছেন। তাই বলে ছোটকাগজ মুভমেন্ট তাদের মত করে চীন্তা করেনা যে, তাঁদের নিজস্ব অবস্থানের জন্যে বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী লেখকদের অশ্রদ্ধা করতে হবে। বরং ছোটকাগজ মুভমেন্ট ও প্রথাবিরূদ্ধ সাহিত্যচর্চ্চাদ্বারা তাদেরকে উদ্বূদ্ধ করে প্রকৃত সাহিত্যচর্চ্চাকে ফরমায়েশীপনা, পুঁজিবাদমুক্ত, সৃজনশীলতার পথে হাটার ও সংশোধনের জন্য অণুপ্রাণিত করে। যদিও বাজারী, ফরমায়েশী, মুনাফা লোভীরা, বুঁর্জোয়া মদদপুষ্ট হওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা প্রতিষ্ঠান এর ছত্রছায়ায় থেকে দ্রæত যশ-খ্যাতি, মুনাফা আর টিনের মেডেল এর লোভ ছাড়তে পারে না বিধায় ঘটা করে ছোটকাগজের মুন্ডুকাটে, বিদ্বেষ ছড়ায়। অথচ ছোটকাগজ মুভমেন্ট তাদের স্বরূপ উন্মোচন করলেও তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে কারন তাদের নিজস্ব চীন্তাশক্তিতো আগেই বুঁর্জোয়দের প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তাই ছোটকাগজ মুভমেন্ট তাঁদের সাথে তাঁদের সাহিত্যকে বাতিল করে দেয়। মেধাদাস দিয়ে আর যাই হোক মৌলিক সাহিত্য রচনা হয় না। যেমন ছাগল দিয়ে লাঙল চষা যায়না।

যেহেতু সকল লেখক একই কারণে লেখেন না। প্রতিটি লেখা একই কারণে রচিত হয়না। একই লোক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়েসে ভিন্ন কারণে লেখেন। ছোটকাগজ মুভমেন্টের লেখকেরা লেখালিখি শুরু করেন বুঁর্জোয়া প্রতিষ্ঠানের ফরমায়েশীপনার বিরূদ্ধে আত্মিক তাগিদে প্রাক-যৌবনের প্রথাবিরোধীতার স্পর্ধায় সাহিত্যপাঠ, বাঙলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মুনাফা লোভীর সীমালঙ্ঘনের প্রতিরোধে ও প্রন্তিক শব্দশিল্পের চাষাবাদের প্রেক্ষিতে।

ছোটকাগজ সাহিত্য তার পাঠকদের লেখকদের মনে বিশেষ এক অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে যে তারা কীভাবে ভবিষ্যতের কল্পনা করে তার ভাল-মন্দ উভয়ই রূপান্তরিত করতে পারে। আধুনিক সাহিত্যের পাঠকদের বর্তমান সময়ের সকল ক্ষেত্রে প্রচলিত অসঙ্গতির বিরূদ্ধে একটি দৃষ্টিভঙ্গি দেয় এবং আমাদের আশেপাশের মানুষের জীবনের, মেধার, চীন্তার বিকাশে আত্ম-স্বধীনতার প্রতিও গুরূত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বা প্রথাবিরোধীতা মানে কি সকল প্রতিষ্ঠান ও প্রচলিত সকল প্রথার বিরূদ্ধতা!
বিষয়টি আসলে তা নয়।

প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা মানে বুঁর্জোয়াদের মদদপুষ্ঠ সেই সব প্রতিষ্ঠান এর বিরোধীতা যা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে মুনাফালাভের উপকরণ আর লেখকে দিয়ে তাদের চাহিদা মাফিক ফরমায়েশী সাহিত্য নামক পণ্যের উৎপাদন করে। বিনিময়ে লেখক নামক মেধাহীন মুন্ডু সর্বস্ব ব্যক্তিটাকে মেধাদাস বানিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত প্রচার, প্রসার, পুরুস্কার, যশ-খ্যাতিসহ মুনাফার কীঞ্চিত ভাগ দিয়ে লালন-পালন করে পুষে রাখে।

আর

প্রথাবিরোধীতা বলতে সেই সব প্রথা যা মানুষকে সংকীর্ণ করে দেয়, সমাজে শ্রেণী বৈষম্যে ও ভেদাভেদ তৈরি করে এবং সামাজিক বৈষম্যের জন্মদেয়। যেমন: ধর্মীয় মৌলবাদ, স্বৈরাচারীত্ব, বৈষম্যমূলক শিক্ষার প্রচলন, বিচারহীনতা, নারী-পুরুষের পার্থক্য, বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন, বাঙলা ভাষার বিকৃতি, সহিত্য কে পণ্যায়ণ প্রভৃতি সামাজিক অসঙ্গতি সমূহ যা সামাজিক বিকাশে সভ্যতার অন্তরায়।

সেই জন্য দেশপ্রেমিকের ‘রাষ্ট্রকে সভ্যতার ও সাংস্কৃতির একত্বের দৃঢ় প্রতিষ্ঠাকল্পে, রাষ্ট্রভাষার, স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অত্যাবশ্যক অঙ্গ বা উপাদান হিসাবে সাহিত্যে এর মুল্যায়ন করে। স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি হল কর্তৃত্বের একত্ব, আর রাষ্ট্রভাষার সাহিত্য হল সেই কর্তৃত্বের প্রতিফলন, অঙ্গীকার এবং অলংকার তাই রাষ্ট্রসত্তার অন্যান্য সমস্ত রূপের মতো রাষ্ট্রভাষারও আছে একই বাধ্যতামূলক এবং সর্বব্যাপী স্বকীয় সমৃদ্ধি। তাই বলা যায় বাজারী বুঁর্জোয়দের মদদপুষ্ঠ ফরমায়েশী সাহিত্য একজন দেশপ্রেমিকের কাছে তার রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ তথা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল।

প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বা প্রথাবিরোধীদের ছোটকাগজ মুভমেন্ট সেইসব রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিরূদ্ধে কতিপয় দেশপ্রেমিকের প্রকাশ্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। একজন খাটি দেশপ্রেমিকেরাই এই উপলব্ধি করতে পারেন, সেই ভাষায় স্বাধীনভাবে সাহিত্যে ও সাহিত্যেচর্চ্চাকে বেগবান ও বাজারী বুঁর্জোয়দের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। বাঙলাভাষাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যা অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হয়েছে, যেজন্য আজ সারাবিশ^ ২১শে ফেব্রæয়ারী কে মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করেন, সম্মান করেন। সেই বাঙলাভাষায় সাহিত্যচর্চ্চায় পুঁজীর দাসত্ব কে বরদাস্ত করা হবে না। সে প্রতিষ্ঠান ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর চেয়ে বড় ও ক্ষমতাশালী হোক না কেন।

আশির দশকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বা প্রথাবিরোধীদের ছোটকাগজ মুভমেন্ট বাংলাদেশে শুরু হয়, কিন্তু নব্বই দশকে যখন প্রিয়মাতৃভ’মি স্বৈরাচার আক্রান্ত হয়েছিল তখন কিন্তু স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন ছোটকাগজ সমূহ ও ছোটকাগজের লেখক, সম্পাদকগণদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে কি পেরেছিলো? এক কথায় বলা যায় পারেনি, তখনকার ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর লেখকদের এমন কোন উল্লেখযোগ্য কবিতা, গদ্য, নাটক বা সম্পাদকীয় বা কোন প্রতিবাদ কেন নেই সে উত্তর এবং এর দায়-দায়িত্ব একান্ত তাদের। শূন্য দশক পূর্ববর্তী ছোটকাগজ এর লেখকেরা শুধু ইশতেহার আর নিজেদের জাহির করতেই ব্যাস্ত ছিলেন। যে কারনে এই মহৎ আন্দোলনটি সামগ্রিক আন্দোলন হয়ে উঠতে পারেনী বলে মনে করি। বর্তমান সময়ের  ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর তরুণরা পূর্ব-পুরুষদের মত নয় এই তরুনেরা বর্ডারে ফেলানী হত্যাকান্ড নিয়ে প্রতিবাদ করে কবিতা লিখেছে, বিনা অনুমতিতে কবিতা ছাপার জন্য ক্ষমতাধর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অনলাইন পত্রিকার বিরূদ্ধে মামলা করে ওদের কে আদালতের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে করজোড়ে ও লিখিত ক্ষমা চাইয়েছে, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সহ প্রখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি তাদের পণ্যে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে অবমাননা করায় আর এক ক্ষমতাধর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রচারণা বিরূদ্ধে প্রকাশ্য ও আইনী প্রতিবাদ করে সেই সব ছবি ব্যবহার করে তাদের পণ্যের প্রচারণা বন্ধ করে দিয়েছে। এখনকার তরূণেরা ইশতেহারের মলাটবন্দী নয়। বিনা অনুমতিতে কবিতা ছাপার প্রতিবাদের সময় আমার পাশে ছিলেন কবি মারুফুল আলম, সম্পাদক, প্রতিশিল্প ও কবি মহিউদ্দীন মোহম্মদ। প্রখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি তাদের পণ্যে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে অবমাননা করার প্রতিবাদের সময় আমার পাশে ছিলেন কবি কামরুল হুদা পথিক, সম্পাদক, দ্রষ্টব্য ও করাতকল এবং কবি শাফি সুমুদ্র ও চিত্রশিল্পী চারুপিন্টু কে। বর্তমানে ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর প্রতিবাদী মুখপাত্র হিসাবে ছোটকাগজ করাতকল নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
সাহিত্যে অতীতের একটি উইন্ডো হিসাবে আমাদেও তথ্য সরবরাহ করে,অতীতের সাথে যোগসূত্র ঘটায়। লেখকেরা এবং পাঠকেরা তাদের পূর্বপুরূষ এবং অন্যরা কীভাবে প্রতিদিনের জীবনের সাথে কেমন আচরণ করেছিল তা দেখতে পাওয়া যায়। লেখকেরা এবং পাঠকেরা দেখতে পাবেন যে তাদের নিজস্ব লোকেরা তখন কি করছিলো, কোথা থেকে এসেছিল এবং তারা যে দেশে বাস করে তা আজকের এই দিনে কি ভাবে পরিণত হয়েছিল। সাহিত্যে তার লেখকেরা এবং পাঠকেরা তাদের পূর্বসূরীদের দ্বারা করা ভুলগুলিও ফিরে তাকালে দেখতে পায় এবং আশায় বুক বাঁধে যে, সেই অতীতের করা ভুলগুলির পুনারাবৃত্তি ঘটবে না। ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর তরুণরা পূর্ব-পুরুষদের মত নিজেদের লেখার সংখ্যা, বইয়ের সংখ্যার বংশবৃদ্ধিতেরত না থেকে মুভমেন্ট এর সামগ্রিকতায় মনোনিবেশ করে কাজ করে যাচ্ছে। এই তরুণদের আরো পরিণত ও দায়িত্বশীল করার দায়িত্ব ছোটকাগজগুলোর সম্পাদক ও অগ্রজদের।
তাই একে অপরের দিকে আঙুল তুলে এগোতে এগোতে এসব দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান গর্ত খুজতে তলানিতে গেলে সকলের জন্যই ক্ষতিকর। ছোটকাগজের সাহিত্যেচর্চ্চায় উভয়কেই জগতের প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনের তাগিদেই আমরা তাদের উপরিউক্ত বাক-বিতন্ডায় নাক না গলিয়ে পূর্ব-পুরূষদের কষ্টার্জিত যাত্রা হতে শিক্ষা নিয়ে লোগোসেন্ট্রিসিজমকে প্রত্যাখ্যান করে খতিয়ে দেখবো রাস্তার কোন জায়গায় খানা আর কোন জায়গায় খন্দ। তবেই এই মুভমেন্ট কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা সহজ ও কার্যকরী হবে।
কার্ল মার্ক্সের সবচেয়ে বড় তত্ত¡ ছিল, ‘পুঁজিবাদ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে। পুঁজিবাদ এমন সব জিনিস তৈরি করবে, যা মানুষের দরকার নেই, কিন্তু তারপরেও সে বস্তুর চাহিদা তৈরি হবে। একেই তিনি ‘কাল্পনিক চাহিদা' বলে নাম দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, যখন সবাই বুঝতে পারবে যে এই পদ্ধতিতে গলদ আছে, তখন তারা নিজেরাই বিদ্রোহ করে বিপ্লব ঘটাবে।” (৬)
তাই আমরা বলতেই পারি যে, বুঁর্জোয়া প্রতিষ্ঠানের ফরমায়েশী লেখক নামক প্রজাতির কিছু বা ক্ষুদ্রাংশ নিজেরাই বিদ্রোহ করে ওদের পালক পিতা, পিতামহ তথা বুঁর্জোয়া কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নিন্দে করবে যখন ওদের ভাগে কম পড়বে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানেরা চুপ করে বসে থাকবে ভাবলে বোকামী হবে, তখন এরা পুঁজীর প্রজনন আরও ব্যাপক হারে বাড়িয়ে দিয়ে নতুন নতুন লেখক নামক প্রডাক্ট জন্ম দেবে এবং মুখে কুলুপ এটে দেবে। প্রয়োজনে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স পদ্ধতির প্রয়োগ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যোগ করবে। তাই ছোটকাগজের কর্মীদের সুসংগঠিত হয়ে সকলকে এককাতারে দাড়িয়ে কর্মপরিকল্পনা করতে হবে, নতুন নতুন ছোটকাগজ প্রকাশসহ নিবেদিত, বিশ^স্ত ও সৎ নতুন লেখকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সারাবিশে^র বাঙলা ভাষাভাষীদের পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য প্রযুক্তির সহায়তায় ছোটকাগজগুলোর প্রিন্ট ভার্সন এর পাশাপাশি অনলাইন ভার্সনও বের করতে হবে। নিয়মিত ছোটকাগজগুলোর লেখক ও সম্পাদকেরা মিলিত হয়ে নিজেদের লেখার পর্যলোচনা করতে হবে, একে অন্যের সাথে নতুন আইডিয়ার শোয়ার করতে হবে। সবাই মিলে সাহিত্যচর্চ্চার খুটিনটি, মুভমেন্ট এর উদ্দেশ্য, বর্তমান অবস্থা, কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন, অর্জনের জন্য করণীয় বিষয়, সাহিত্যচর্চ্চার জন্য নিয়ন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা চালু রাখতে হবে। তানা হলে ছোটকাগজ আন্দোলন অবসম্ভাবী ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হবে। বুঁর্জোয়া মালগুলো ছোটকাগজ আন্দোলনকে বাধা দিতে ছোটকাগজের লেখকদের কে পথভ্রষ্ট করার সব রকম প্রচেষ্টা চালাবে, তিরস্কারে কাজ না হলে পুরুস্কার দেবে তাই পাশাপাশি সজাগ থাকতে হবে। ছোটকাগজ আন্দোলনে নতুনদের সম্পৃক্ত করার সময় সতর্ক হতে হবে আর সিনিয়রদেরও প্রতি সজাগ থাকতে হবে। কেউ জানেনা কখন কে যে বিশ^াসভঙ্গকারী হবে।
ভাবতে অবাকলাগে কিভাবে একজন লেখক নিজের মেধাবিক্রি করে দেয়! নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়? আর এটা অস্বীকার করতে না পারলে খাঁচার পোষা পাখি হয়েই বাঁচতেই হবে। পরাধীনতা আর নির্লজ্জ দালালীর চেয়ে অনাহারে মৃত্যুবরণও ছোটকাগজ আন্দোলনের কর্মীদের কাছে শ্রেয়, এজন্য তারাই বিকল্প ভাবনা ভাবতে থাকেন। সেটা হতে পারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য আবার হতে পারে গান, নাচ, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র কিংবা অন্য মাধ্যমে।

যে কোনো মানুষ যখন সাহিত্যচর্চ্চা করেন, তখন তিনি এমন এক ভাষা পেয়ে যান যা যুক্তি পরম্পরার লৌহ- শৃঙ্খলে বাঁধা নয়। সেই ভাষায় তাকে তার অস্তিত্বের মৌলিক অবস্থানটিকে দেখিয়ে দেবে। আমি কোনো মূল্যবোধকেই স্থায়ী বলে স্বীকার না করেই শুরূ করেছিলাম। কিন্তু এই কাজ করে কীভাবে জীবনের পথে এগোনো সম্ভব তার কোনো রূপরেখা দিতে পারব না। যিনি ছোটকাগজ আন্দোলনে নিজেকে সমার্ম্পন করেন তিনি তার জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই ঠিক করে নেবেন যে তাঁর মৌলিক সত্তার প্রকাশটিকেই স্বাভাবিক এবং সাবলীল রাখতে গেলে কী করতে হবে। আর গ্রহণ এবং অস্বীকারের নির্দেশটি তখন পাওয়া যাবে নিজের ভেতর থেকেই। এই বোধ না থাকলে তার ছোটকাগজ আন্দোলনে আসার দরকার নেই।

কেন এই ছোটকাগজ আন্দোলনে নিজেকে সমার্ম্পন করেছি এই অমূলক প্রশ্নটা আমার কোনো ভারবাহী জিজ্ঞাসাবোধের অন্তর্গত ছিল না যদিও, একটি দার্শনিক চীন্তা হিসাবে প্রতিনিয়ত আমাকে এমনভাবে চিন্তিত রেখেছে যে, প্রশ্নহীনতা, চিন্তাহীনতা, এমনকি চেতনাবোধ গুলিয়ে ফেলেও, আমার লেখার সম্ভাবনা থেকে, লিখিত পাঠবস্তু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার, কোনো সদুত্তর পাই না। আমার মধ্যে আমার লেখার প্রক্রিয়াটি নিজের মত, হয়ত ওই প্রশ্নটির এটিই সঠিক উত্তর। আমি কেন লিখি, এই সমস্যাটি, সারাজীবন একই দার্শনিকতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না, কেন না, একজন মানুষের মানসিক অবস্থানগুলোর সুস্পষ্ট জলবিভাজন থাকে না। স্থান, কাল, অব¯া’, বয়ষ এবং প্রেক্ষাপট ভেদে তা পরিবর্তিত হয়।

স্বৈরাচার বেশে অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে, আর কতদিন একসাথে থাকা যায়? এই বিচ্ছিন্নতাই এই ছোটকাগজ গুলোকে পতনের দিকে ধাবিত করেছে।। ছোটকাগজ কে পাঠক তৈরিও করতে হয়। অথচ আতীত হতে সা¤প্রতিক সময়ে কয়েকটি ছোটকাগজ সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে একেকটি সংখ্যা প্রকাশ, লেখার মান, দর্শন, নিরীক্ষা করে ছোটকাগজের পাঠক তৈরির কাজটি সুন্দরভাবে করে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠান/অপ্রতিষ্ঠান,বাজারী/অবাজারী, পণ্য/পণ্যহীন এইসব অভিধার অনেকরকম ভুলভাল (যুক্তিহীন) ব্যাখ্যা হাজির ও প্রচার করে করে ঐ ছোটকাগজ গুলো শেষমেষ মানসিকতায় অতি ক্ষুদ্রাকৃতির প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, মৌলবাদি গোষ্ঠীবদ্ধতায় লজ্জাজনক আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। একথা যারা বলছেন সময়ই তাদের উত্তর দিয়ে দেবে। আমাদের বিচলিত হবার কিছু নেই। তাদের বক্তব্য অন্তঃসারশূণ্য আস্ফলন ছাড়া কিছুই নয়।

ভালো ভালো লেখার সাথে নিজেকে পরিচিত করাও, এমনকি সাধারণ লেখাগুলোর সাথেও!

এটাই সবচে গুরূত্বপূর্ন কাজ। বাঙলাদেশে উল্যেখযোগ্য যত লেখক তৈরি হয়েছেন প্রায় প্রত্যেকেরই জন্মস্থান ছোটকাগজে। অথচ এর পর থেকে এই পরিস্থিতি প্রায় সম্পূর্ণই পাল্টে গেছে! যে ছোটকাগজগুলো একসময় বাঙলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, তারূণ্যকে ধারণ করেছে, তার অধিকাংশই সময়ের প্রয়োজনে বন্ধ হয়ে গেলেও হাতেগোণা কয়েকটি ছোটকাগজ বর্তমানে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো সংখ্যায় কম হলেও শিল্পের কলরবে মুখর হয়ে উঠতে সহায়কের ভ’মিকা রাখছে। অনেকে বলেন, এখনকার ছোটকাগজের সাথে যুক্ত হবার জন্য এখন আর শিল্পচর্চ্চার যোগ্যতার দরকার পড়ে না। বিষয়টি হাস্যকর, তিনারা কোন কাগজগুলোকে ছোটকাগজ বলছেন, যদি তারা গান্ডিব, শিরদাঁড়া, দুয়েন্দু, প্রতিশিল্প, দ্রষ্টব্য, গ্রফিত্তি, করাতকল, সূর্যঘড়ি, শ্লোক, শাব্দিক, শিং, কামারশালা, প্রকাশিতব্য যশোর রোডের কথা বলে থাকেন তবে ভুল বলেছেন। তাদের ছোটকাগজ কি, কাকে বলে এ সম্পর্কে একদম ধারনা নেই। মৌলিক ছোটকাগজের সাথে যুক্ত হবার জন্য প্রথম যোগ্যতাই হল শিল্পচর্চ্চার যোগ্যতা।

যে জিনিসটা ছোটকাগজ মুভমেন্টে চাইনা সেটা হল নিগ্রহ। মানুষকে মুগুরপেটা করে তাড়িয়ে নিয়ে স্বর্গে তোলা হয়, সেটা আমরা চাইনা। যা সবচেয়ে গুরূত্বসম্পন্ন, তার বৈরিতা তীব্রতর হবে, হাজার নতুন রূপের বিরোধ সৃষ্টি হবে, ক্ষোভ বাড়বে, বাড়বে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, ইত্যাদি। এটাইতো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। দিনশেষে এরাই আবার এক সুরে গাইবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছোটকাগজ মুভমেন্ট এ রয়েছে কারন এরা কারও ফরমায়েশী পোষাপাখি নয়।

সাহিত্য আন্দোলনের ক্রমবিকাশের দিকে তাকালে পরিলক্ষিত হয় যে, ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম হল সময়-তাড়িত চিন্তাতন্ত্রের ফসল, জুডিও-ক্রিশ্চিয়ানিটির ফসল। হাংরিয়ালিজম হল পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রের ফসল, বহুত্ববাদী ভাবনার ফসল। ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম লেখককে তার মস্তিষ্ক থেকে আলাদা করে ভেবেছে। হাংরিয়ালিজম লেখককে একলেকটিক বলে মেনে নিয়েছে। ডাডাবাদী-পরাবাস্তববাদীরা জন্মেছেন আর্ট ফর আর্ট সেক-এর পৃষ্ঠপটে, তাই ভাঙচুর করছেন। হাংরিয়ালিস্টরা ‘আর্ট’ কনসেপ্টটাকেই আক্রমণ করেছেন। আর ছোটকাগজ মুভমেন্ট হল সামগ্রিকতার ভাবনা ও সাহিত্যেকে পণ্যায়নে রূপান্তরের প্রতিবাদ। পাশাপাশি খাটি বাঙালীত্ব ও বাঙলা ভাষার প্রান্তিকচর্চ্চা করা ও বাঙালীত্বের চেতনা ও বাঙলা ভাষার বিকৃতায়ন হতে রক্ষার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মত পাহারা দেওয়া। সকল প্রকারের যশ, খ্যাতি, মোহ, পুরুস্কার, মুনাফার লোভ বিসর্জন দিয়ে নিজের ভেতরের তাগিদে, বাঙালীত্বের চেতনা ও বাঙলা ভাষার তাগিদে শব্দশিল্পের বিন্যাস ঘটিয়ে নিয়ত নতুন নতুন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে সামগ্রিক সাহিত্যচর্চ্চা করা।

ছোটকাগজে সাহিত্যচর্চ্চাই জীবনের ভিত্তি। এটি মানব ট্রাজেডি থেকে শুরু করে ভালবাসার জন্য সর্বদা অ-জনপ্রিয় অনুসন্ধানের গল্পগুলিতে অনেক বিষয়ক গুরূত্ব দেয়, এটি শারীরিকভাবে কথায় লেখা হলেও এই শব্দগুলি মনের কল্পনায় এবং পাঠ্যের জটিলতা বা সরলতা বোঝার দক্ষতায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ছোটকাগজের সাহিত্য মানুষকে অন্যের লেন্সের মাধ্যমে দেখতে সক্ষম করে তোলে এবং কখনও কখনও নির্র্জীব বস্তুগুলিকেও। অতএব, অন্যরা এটি দেখার সাথে সাথে এটি বিশ্বে এক তীক্ষè দূরবীণে পরিণত হয়। এটি এমন একটি ভ্রমণ যা পৃষ্ঠাগুলিতে খোদাই করা আছে এবং পাঠকের কল্পনাশক্তি দ্বারা চালিত। পরিশেষে, ছোটকাগজ সাহিত্যের সবচেয়ে দুঃখজনক গল্পগুলি থেকে, সবচেয়ে আনন্দদায়ক গল্পগুলির কাছে জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পাঠককে পাঠানোর একটি প্রবেশদ্বার সরবরাহ করে যা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করবে।

সাহিত্যের বাজার হয়ে উঠেছে প্রধান ডিসকোর্স। ছোটকাগজ মুভমেন্ট প্রক্রিয়াটাই আজ কাউন্টার-ডিসকোর্সের চেহারা নিতে বাধ্য হয়েছে। ছোটকাগজেরকর্মীরা যেন গোপন সমিতির সদস্য। তার বাইরে বেরোলেই ঢুকতে হবে বাজারে। ক্রমবর্ধমানভাবে, লোকেরা বড় হওয়ার সাথে সাথে তারা অন্যান্য ঘরানার তথা ছোটকাগজের বইগুলি আবিষ্কার করে, যেগুলি তাদের বিষয়টির প্রতি কৌতূহল বাড়িয়ে সামগ্রিক ছোটকাগজ এর বইয়ের দিকে চালিত করে। পাঠক সমাজকে সাহিত্যের আসল গুরুত্ব আবিষ্কার করতে প্রস্তুত করে, সামগ্রিক পরিস্থিতিগুলিকে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা ও বুঝতে সক্ষম করার প্রচেষ্টা চালায় এবং সাহিত্যের জগতের চাবিগুলি খোলা এবং দেওয়ায় ক্রমশ অভ্যস্ত করে তোলে ছোটকাগজ মুভমেন্ট। ।

এজন্য ছোটকাগজে সাহিত্যেচর্চ্চা শুরু করার জন্য মুভমেন্ট পাঠ্যের প্রসঙ্গে বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে প্রলুব্ধ করে! যে রাজনীতিবীদ আন্দোলন,সংগ্রাম, জেল খাটতে খাটতে সমস্ত জীবন খুইয়েছেন, তার তুলনায় যে লোকটা থিয়েটার বা লিটলম্যাগ করতে করতে ফতুর হয়ে গেছেন, তার অবদান কোনো অংশেই কম নয়।

যে কোনো তথ্যই ছোটকাগজ মুভমেন্ট বহন করবার চেষ্টা করে না কেন, যে কোনো কিছুর সামনে পাঠকের অনুভূতির দুয়ার খুলে দিতে চায় না কেন- যে জিনিসটি প্রথম করতে হবে, তা হলো- ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর কনসেপ্ট কে পাঠকের কাছে সরল ভাবে খোলসা করতে হবে। শুধু রোক দেখানো ইশতেহার লিখে, ছোটকাগজেরকর্মী তকমা লাগিয়ে সুনির্দ্দিষ্ট কয়েকজন লেখক দিয়ে একের পর এক সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ না করে নতুন নতুন তরুণদেরকে প্রাধন্য দিয়ে নতুন লেখা ও লেখক আবিস্কার এর দিকে সম্পাদকদের মনোনিবেশ করতে হবে। নইলে ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর স্বকীয় মৌলিকত্ব ও আভিজাত্য হারিয়ে যাবে।

যেসকল তরূনেরা ছোটকাগজ মুভমেন্টে আগ্রহী সেই নতুন ছোটকাগজকর্মীদের জন্য পরামর্শ হল আপনি একটি বিষয় কে আপনার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে বেছে নিন যা প্রাথমিকভাবে আপনাকে ছুঁড়ে দেয়। আপনি যখন প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বারের জন্য পাঠটি পড়বন তখন কিছু নির্দিষ্ট পয়েট এবং থিম থাকবে যা সেগুলি আপনার কাছে উপস্থাপন করবে। এগুলি বিশ্লেষণ করে আপনি তাদেরকে কীসের সাথে সংযুক্ত করে তা দেখতে সক্ষম হবেন এবং সম্ভবত কোনও নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাদের সম্পর্কিত করতে সক্ষম হবেন। এটা পারলে আপনি নিজেই ভেতর থেকে উত্তর পেয়ে যাবেন আপনি ছোটকাগজ মুভমেন্ট এর জন্য প্রাথমিক ভাবে প্রস্তুত কিনা। সব লেখকের জন্মগত অধিকার ভাষার সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, যতভাবে ভাবা যায়। এই বিষয়টি ছাড়া নতুন কোনোকিছু জন্মাতে পারে না। নানা এলাকার নানা রকম মানুষের সঙ্গে যত বেশি মেশা যায়, একজন লেখক ও ভাবুক তত বেশি সমৃদ্ধ হন। নির্জনে বসে প্রাপ্ত বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন। আপনি নিজেই আবিস্কার করতে শিখবেন নিজস্ব সাহিত্যভাষা, নান্দনিক ভাবে নিজের লেখায় এর প্রয়োগ করবেন, বাতিল করবেন। পরিশেষে সৃজনশীল চীন্তা, আত্মিক সততা, নিষ্ঠা, স্থৈর্য, এবং নির্মোহ ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ আপনার লেখায় প্রয়োগ করতে পারলে ছোটকাগজ মুভমেন্টে আপনার অবস্থান নিজেই আবিস্কার করতে পারবেন।
আর যদি কোন দ্বীধা বা সংশয় থাকে, যশ, খ্যাতির মোহ, অর্থবিত্ত, পুরুস্কার, সম্মাননার প্রতি ঝোঁক থাকে তাহলে এটা আপনার জায়গা নয়। খামাখা এখানে সময় নষ্ট না করে আশপাশ হাতড়ে দেখেন, দুই-একজন বাজারী কাগজের সাময়িকী সম্পাদকের তোষামেদী করুন, নিয়মিত তিনাদের ফরমায়েশ ও খায়েশ মেটান, আপনার লেখালেখীর নুন্যতম যোগ্যতা ছাড়াই রাতারাতী অত্যাধুনিক লেখক হয়ে যাবেন। একদিন গলায় মেডেল পাবেন আর আপনার কুখ্যাত পাঠ্যের জন্য বিরাট ওয়াজ মাহফিলের সমাগমের মত সাজুগুজু করা শ্রোতা পাবেন। কচি, ঢ্যামনা, ধাড়ী, ডেপসী বিভন্ন ফ্লেবারের ভক্তও জুটে যাবে এক সময়।
হাতি-ঘোড়া গেল তল, গাঁধা বলে মাইরি কত জল।
ছোটকাগজ মুভমেন্টে ন্যাকামির জায়গা নয় তাই এখানে থেকে শিখে পড়ে সুযোগ বুঝে কেটে পড়া ভবিষৎ এর চুদির ভাই না হয়ে সাধুগণ শুরুতেই কেটে পড়–ন, এখানে মেধাদাসদের কোন স্থান নেই। আপনার কিম্বা আপনার পালক পিতার (বাজারী সাময়িকী সম্পাদক/বাজারী প্রকাশক) চেয়ে মহানদের কে অনেক আগেই বাতিল করে দিয়েছে ছোটকাগজ মুভমেন্টে। তথাকথিত বুঁর্জোয়া, মুনাফা লোভী, পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু ফরমায়েশী সাহিত্যিকগণদের তৈরি সকল বাজারি প্রডাক্ট বা পণ্য সহ সকল লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশকদের দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করে, অস্বীকার করে।
 ---------------------------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
১) হারুকি মুরাকামি (মুরাকামি হারুকি, জন্মঃ১২ জানুয়ারি ১৯৪৯) একজন জনপ্রিয় জাপানী লেখক।
২) কবি শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬২) ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি, সমালোচক ও অনুবাদক।
৩) সুবিমল মিশ্র, ছোটকাগজ মুভমেন্টে এর প্রবাদ পুরূষ, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার প্রবাক্তা।
৪)  সুভাষ ঘোষ। কবি ও গদ্যকার, পশ্চিম বাংলার হাংরি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
৫) কবির বিশ্বরূপ : শৈলেশ্বর ঘোষ, কারূবাসনা, আভাঁগার্দ পত্রিকা শৈলেশ্বর ঘোষ স্মরণিকাঃ নেভেম্বর, ২০১২,
সম্পাদক: সব্যসাচী সেন, কোলকাতা।
৬) কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র ১৮৪৮।




কোন মন্তব্য নেই