বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিলম্যাগাজিন ব্লগ

সাম্প্রতিক পোষ্ট

অবিচার : সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ



অবিচার : সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ


আজ বৃহষ্পতি বার। কালী পূজা চলছে মহা ধুমধামে।
চারদিকে থমথমে নিরব প্রকৃতি যেন সেজে বসে আছে শিব রাত্রী কে স্বাগতম জানানোর জন্য। অমাবশ্যা রাতের মজাটাই ডেন একটু আলাদা। যদি শহরে লোড শেডিং হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই নীম রাতে উচ্ছন্নে যেতে কার না ভাল লাগে। প্রতি বছরের মত বিকাল হতেই সারা রাত মাল খাবার প্রস্ততি চলছে আমাদের মধ্যে। সঞ্চয়, সুদাম, পাবিত্র, সুদেব, রাসেল আর আমি নিজেদের মধ্যে সলাুপরামর্শ করছি। কখন থেকে আমাদের উৎসব শুরু হবে। সন্ধা গড়াতেই পবিত্র আর আমি নয়ন কাকার দোকান হতে দু’টা গোল্ডেন রিবন এর ফেমিলি সাইজের বোতল নিয়ে হাজির হলাম ভোজনের ছাদে। আমরা আসার আগেই সঞ্চয়, সুদাম, আপেল, কাবাব, জুস, সিগারেট এনে রেখেছে। গলা পর্যন্ত খাবার প্রতিযোগিতা শুরু হল। এর মধ্যে বকচর এর সঞ্চয় অনেক খানি গাজা নিয়ে হাজির।

সারা শহরে লোড শেডিং চলছে। আটটা নাগাদ এলোমেলো হয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম শশ্মানের উদ্দেশ্যে। সুদেব একেরপর এক গান গেয়ে চলছে। একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে রিকশা নিলাম। শশ্মানে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত তখন দশটা।

এর মধ্যে অনেক মাতাল মানুষের ভিড় জমেছে শশ্মানে।
চারদিকে সুনসান নিরবতা। মানুষ পোড়ানো চিতা গুলোকে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করা হয়েছে। প্রতিটি ঝোপ-ঝাড়ে, কবরের পাশে জয় বাবা ভোলা নাথ, জয় বাবা মাতালধারী জোনাকী পোকার সাথে তাল মিলিয়ে নিভছে আর জ্বলছে। এই শহরে গঙ্গা নেই, তবে নদী একটা আছে। মৃত ভৈরব। ন্যতানো শিং মাছের মত শুয়ে আছে নীলগন্জ শশ্মান ঘেষে। সদ্য পোঁড়ানো লাশের গন্ধ। বাশের ডগায় গোজা মানুষের অস্থি পুতে রাখা আছে চিতার কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয় কাঙাল নদীর বুকে। পুতে রাখা মানুষের অসস্থি, কবরে ইদুর, শিয়াল, কুকুর অজ¯্র গর্ত করে রেখেছে। নিঃশব্দ নিরব এই নিরবতা ভাঙ্গছে মাতালের বমির শব্দে, উথালি-পাথলি উন্মদনায়। ছেলে-বুড়ো, নাবালক সব বয়ষের মানুষের আজ এখানে বড্ড অপরিচিত। সবার মিল একটাই সবাই আজ মাতাল।

শশ্মানের পুকুর ঘাটে আমরা সবাই গোল হয়ে বসে গাজা টানছি। এক হাতথেকে অন্য হাতে ঘুরছে পোঁড়া মাটির কলকে। রাত একটু গভীর হতেই আমরাও লোড শেডিং কারও ভাল না লাগুক আমাদের মন্দ লাগেনি।

অনেকক্ষন আমরা কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছিনা। একটু দূরে ভিড় ঠেলে দেখলাম একটা চিতাকে ঘিরে অনেক মানুষ হৈ হুল্লড় করছে। আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি একটি মেয়ে ক্যাভেরের নাচ-নেয়ালীদের মত করে বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গি করে কাম ভাব প্রকাশ করছে। প্রদীপের আলোতে তার দেহের অঙ্গ ভঙ্গি মাতাল পুরীর মানুষদের কে বাড়তি আনন্দ দান করছে। অনেকক্ষন ধরে মেয়েটি নাচল। মা-ে মধ্যে কয়েকটা ছেলে তার সাথে যোগ দিচ্ছে। চিৎকার করছে, শিস দিচ্ছে।

মেয়েটির ক্লান্ত দেহ, নিস্তেজ স্তন যুগল আর ঘাসে ভেজা মলিন মুখ কারও কারো যৌন উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষন দূরে দাড়িয়ে থেকে আমি একটু এগিয়ে গেলাম ভিড় ঠেলে একেবারে চিতার কাছে। মাতাল মনন দিয়ে মেয়েটি আর ন্যাতানো ভৈরবের মধ্যে কোন পার্থক্য না পেলেও তার শরীরে কামের জিজ্ঞাসা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আর ভাল লাগল না।
একা একা ফিরে এসে সঞ্চয়ের কাছ থেকে দুটো গাজার স্টিক নিয়ে ফিরব এর মধ্যে সুদাম কোথা হতে এসে এক বেতল মদ আমার হাতে দিল। আমি সেটা নিয়ে নির্জনতা খুজতে খুজতে মধ্য শশ্মানের পুরানো কবর আর ভাঙ্গা মন্দিরটার দিকে যাবার পায়ে হাটা পথে নদীর গা ঘেষে একটা কবর এর উপরে বসে বোতল খুললাম। দু-তিন ডোগ খেয়ে এককটি গাঁজার স্টিক ধরলাম।

নদীর দিকে, আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে,
মনে হচ্ছে পুঁড়ে যাচ্ছি পাঁপে। গলে যাচ্ছি ধাপে ধাপে।

হঠাৎ করেই চোখ গেল বট গাছটার নীচে, কে জানি হেলান দিয়ে নিথর হয়ে বসে আছে। প্রথমে মনে হল হয়তো কোন মাতাল অপ্সান হয়ে পড়ে আছে। এগিয়ে গেলাম একটু গিয়ে দেখি সেই মেয়েটি একা একা ফুপিয়ে কাদছে আর সিগারেট খাচ্ছে। কঙ্কনা সেন এর মত মাতাল মেয়েটিকে মনেহলো। কিন্তু সে কাঁদছে কেন। আমি আর জিজ্ঞাসা না করে ফিরে যাচ্ছি এমন সময় পুরুষ কন্ঠে কে জানি আমায় বলল তোর কাছে মাল হবে। চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখি আর কেউ না সেই মেয়েটি। কিছুটা ভয় ও পেলাম। উদভ্রান্ত খোলা চুল উড়ছে, পরনে মলিস মেরুন রঙের শাড়িটি দেখেঅন্ধকারে কালো কাপড় জড়ানো মনে হচ্ছে। খেয়াল করে দেখলাম ব্লাউজের হাতা ছেড়া । লম্বা নখের নেল পালিশেয়লা হাত বাড়িয়ে মদের বোতলটি আমার কাছ থেকে এক প্রকার কেড়ে নিল । ঢকঢক করে কয়েক ঢোগ গিলল জেন তৃষ্ণার্ত কেউ পানি খাচ্ছে।

তোর কাছে সিগারেট হবে? আমাকে বলল।
হবে! দে ঠোটে গুজে দে। ধরিয়ে দিলাম। দেশলাইয়ের আলাতে ওর মুখে সস্তা প্রসাধনীর কড়া ছাপ স্পষ্ট। চোখের জলে মোছা কাজল, আর হু হু করে আসা বন্যার আগাম পূর্বাভাস তার চোখে।

আমি নির্বাক। কতক্ষন কথাবলিনি আমি জানি না। আমি আবার কয়েক ঢোক গিলে বোতল টা বাড়িয়ে দিলাম। সিগারেট ধরাচ্ছি এর মধ্যে শিয়াল কুকুর হৈ হৈ করে ডাকছে। সাথে মানুষের জয় বাবা ভোলা নাথ চিৎকার। সবমিলে অমানশ্যার শহরে আমি নির্জন, একা।
মেয়েটি, আবার ও গাঁজার ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আমাকে বলল, আমার নাম অনিতা,আমি হিজড়া। আমারোতো যৌনকর্মে লিপ্ত হতে ইচ্ছে করে। সে ইচ্ছোঁ পুরণ হতে দেয়নি শিব। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল আবার। বিশ্রি ভাষায় খিস্তি আউড়াতে আউড়াতে শিবের গুষ্ঠি উদ্ধার করল।

আমি নির্বাক, হতবাক নয়নে অমাবশ্যার মত নিথর পড়ে রইলাম তার দিকে চেয়ে।
আমার সব ঘোর যেন কেটে যাচ্ছে।

১৯ / ০৩ / ২০০৯

কোন মন্তব্য নেই